পল্লিচিকিৎসক হিসেবে সুনাম ছিল আবদুস সোবহানের। স্থানীয়ভাবে তিনি ‘সোবহান ডাক্তার’ নামে পরিচিত ছিলেন। শিক্ষানুরাগী আর পরোপকারী ছিলেন। এলাকায় একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলায় অবদান রেখেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্থানীয় যুবকদের প্রশিক্ষণ দিতেন। নিজেও অংশ নিয়েছিলেন প্রত্যক্ষ যুদ্ধে। একপর্যায়ে রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি ঘাতক সেনারা তাঁকে ধরে ফেলে। নির্মম নির্যাতন করে হত্যার পর আবদুস সোবহানের লাশ ভাসিয়ে দেয় কংস নদে।
শহীদ আবদুস সোবহানের জন্মসাল তাঁর পরিবারের কেউ সঠিক বলতে পারেননি। মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স হয়েছিল আনুমানিক ৫৫ বছর। বাড়ি কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার জঙ্গলবাড়ি মুসলিমপাড়ায়। বাবার নাম আইন উদ্দিন মুন্সি। চার ভাই, এক বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। জেলা শহরের আজিম উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করে তিনি আর্মি মেডিকেল কোরে যোগ দেন। স্বাধীনতাযুদ্ধের আগে তিনি অবসর নিয়ে বাড়িতে চলে আসেন। বাড়িতে এসে এলাকার শিক্ষার প্রসারে স্কুল প্রতিষ্ঠাসহ সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজের পাশাপাশি বাম রাজনীতিতে যুক্ত হন। শহীদ আবদুস সোবহানের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি রয়েছে বাংলা একাডেমির শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থে।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও এলাকাবাসী জানান, সোবহান পল্লিচিকিৎসক হিসেবে সেবা দিতেন। তিনি করিমগঞ্জ থানা ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ মোজাফ্ফর) সহসভাপতি ছিলেন। মূলত তাঁর উদ্যোগেই স্থানীয় জঙ্গলবাড়ি উচ্চবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।
একাত্তরের ২৫ মার্চ হানাদার বাহিনী গণহত্যা শুরু করলে পরদিন থেকেই সোবহান ছাত্র ও যুবকদের বাঁশের লাঠি ও দেশি অস্ত্র দিয়ে প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন। সামরিক বাহিনীতে কাজ করায় তাঁর নিজের যুদ্ধের প্রশিক্ষণ ছিল। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে তিনি স্থানীয় জাফরাবাদ ইউনিয়ন পরিষদ মাঠ ও জঙ্গলবাড়ি উচ্চবিদ্যালয় মাঠে দুই শতাধিক তরুণ মুক্তিযোদ্ধাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করে তুলেছিলেন। একাত্তরের ১৯ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী কিশোরগঞ্জ মহকুমায় প্রবেশ করলে তাঁর প্রশিক্ষণ ক্যাম্প বন্ধ হয়ে যায়। তিনি নেত্রকোনায় চলে যান। সেখানে তিনি ১১ নম্বর সেক্টরের একজন প্লাটুন কমান্ডার হিসেবে যুদ্ধে অংশ নেন।
মোহনগঞ্জে পাকিস্তানি বাহিনী একটি ক্যাম্প স্থাপন করে। ২ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় তিনি গোপনে সেই ক্যাম্প রেকি করতে যান। এ সময় রাজাকারদের সাহায্যে পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে ধরে ফেলে।
সম্প্রতি শহীদ আবদুস সোবহানের বাড়িতে কথা হয় তাঁর ছেলে জামিল আনসারীর সঙ্গে। তিনি বলেন, তাঁরা ছিলেন পাঁচ ভাই ও তিন বোন। বাবার অবর্তমানে তাঁদের মা আলীমুন্নেছা লাইলা অনেক কষ্টে সংসার চালিয়েছেন। তাঁর মা এখন বেঁচে নেই। ঘাতকেরা তাঁর বাবাকে অন্য একজনের সঙ্গে পিঠমোড়া করে বেঁধে নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ গার্লস স্কুলের পেছনে কংস নদের পাড়ে গুলি করে হত্যা করে লাশ ভাসিয়ে দেয়। আত্মীয়রা নদ থেকে লাশ আনতে গেলে ঘাতকেরা বাধা দেয়, বাড়িতে হামলা চালিয়ে ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়।
গ্রন্থনা: তাফসিলুল আজিজ, প্রতিনিধি, কিশোরগঞ্জ।