সুঠাম দেহের অধিকারী ছিলেন কুষ্টিয়া সরকারি মহিলা কলেজের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক দুর্গাদাস সাহা। নিয়মিত শরীচর্চা করতেন। কুষ্টিয়ার জিমন্যাস্টিক ক্লাবের সঙ্গে তিনি দীর্ঘদিন জড়িত ছিলেন। তাঁর প্রচেষ্টায় এলাকায় ইউনাইটেড ইয়াং ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কুষ্টিয়া শহরসংলগ্ন বাড়াদি গ্রামে তাঁদের বাড়ির সামনের জায়গায় সবজি চাষ করতে ভালোবাসতেন। এলাকায় তিনি মধু নামে পরিচিত ছিলেন। মানুষের বিপদে ছুটে যেতেন তিনি।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী একাত্তরের মধ্য এপ্রিলে কুষ্টিয়ায় আক্রমণ করে। পাকিস্তানি ঘাতক ও তাদের দোসর রাজাকার–আলবদররা শহর ও আশপাশের গ্রামগুলোতে ব্যাপক লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, নির্যাতন ও গণহত্যা চালাতে থাকে। দুর্গাদাস সাহাকে তারা বাড়ির পাশ থেকে ধরে নিয়ে নির্মম নির্যাতন করে হত্যা করে।
বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত রশীদ হায়দার সম্পাদিত স্মৃতি ১৯৭১–এর পুনর্বিন্যাসকৃত প্রথম খণ্ডে অধ্যাপক ও গবেষক আবুল আহসান চৌধুরী আমার আপনজন নামের স্মৃতিচারণায় শহীদ দুর্গাদাসের পরিচিতি ও হত্যার বিবরণ তুলে ধরেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, সেদিন ছিল ২০ এপ্রিল। সকালে দুর্গাদাস স্নানের জন্য তৈরি হচ্ছিলেন। মাথায় তেল মাখতে মাখতে তিনি তাঁর ভাইপো অমল কুমার সাহাকে পাশের বাড়ির চাপকল থেকে পানি আনতে পাঠান। এ সময় এলাকার এক ব্যক্তি এসে দুর্গাদাস সাহাকে জানান, তাঁদের প্রতিবেশী ফন্টু সাহার বাড়িতে রাজাকাররা লুটপাট করছে। ফন্টুকে সাহায্যের জন্য যাওয়া দরকার। খবর পেয়েই দুর্গাদাস লুঙ্গি পরা অবস্থায় গামছা কাঁধে নিয়ে ছুটে যান। তাঁর মা গৌরীবালা ছেলেকে খাবার খেয়ে যাওয়ার কথা বলেছিলেন। দুর্গাদাস বলেছিলেন, ফিরে এসে খাবেন। কিন্তু তিনি আর ফেরেননি।
পরিবারের সদস্যরা পরে জানতে পারেন, দুর্গাদাসকে অবাঙালি রাজাকাররা ধরে নিয়ে গেছে। প্রথমে তাঁকে পুলিশ লাইনসে আটকে রাখা হয়। সেখানে উল্টো করে ঝুলিয়ে অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। এক দিন পর পাশেই ঘোরলাইন এলাকায় রেললাইনের ধারে দুর্গাদাসকে জবাই করে হত্যা করা হয়। কিন্তু পরিবার তাঁর লাশ পায়নি।
দুর্গাদাস সাহার জন্ম ১৯৪২ সালের ১৭ ডিসেম্বর। বাবা হরিদাস সাহা ও মা গৌরীবালা। চার ভাইয়ের মধ্যে দুর্গাদাস সবার ছোট। দুর্গাদাস ১৯৬২ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। কুষ্টিয়া কলেজ থেকে বিজ্ঞানে মাধ্যমিক ও স্নাতক পাস করেন। ১৯৬৯ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর তিনি কুষ্টিয়া সরকারি মহিলা কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন।
শহীদ দুর্গাদাস সাহা বিয়ে করেননি। তাঁর ষাটোর্ধ্ব ভাইপো অমল কুমার সাহা বলেন, ‘রাজাকাররা আমার সামনে থেকে তাঁকে ধরে নিয়ে যায়। শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে তাঁকে সরকার স্বীকৃতি দিলে বা তাঁর স্মৃতি রক্ষায় কোনো উদ্যোগ নেওয়া হলে আমাদের ভালো লাগত। এ ছাড়া কিছুই চাওয়ার নেই।’
গ্রন্থনা: তৌহিদী হাসান, কুষ্টিয়া