বিজ্ঞাপন
default-image

নির্বিরোধী, বন্ধুবৎসল ও স্নেহপরায়ণ ছিলেন ডা. নইমুল ইসলাম। চিকিৎসক হিসেবে তাঁর সুনাম ছিল।

একাত্তরে কর্মরত ছিলেন গাজীপুর সমরাস্ত্র কারখানায়। থাকতেন সমরাস্ত্র কারখানার আবাসিক এলাকায়।

অসহযোগ আন্দোলনকালে জয়দেবপুরে হাসান নামে আহত একজনের চিকিৎসার জন্য একজন অবাঙালি কর্মকর্তার সঙ্গে তাঁর বাদানুবাদ হয়।

ওই অবাঙালি কর্মকর্তা তাঁকে বলেছিল, ‘হাসান বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে আর তুমি তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করছিলে? তোমাকে রক্ষা করা হবে না।’

২৯ মার্চ বিকেলে একদল পাকিস্তানি সেনা তাঁর বাসা ঘিরে ফেলে। তখন থেকে ২ এপ্রিল পর্যন্ত তিনি গৃহবন্দী ছিলেন।

সেনারা জিজ্ঞাসাবাদের নামে প্রতিদিন তাঁকে বাসা থেকে নিয়ে যেত আবার রেখে যেত। এরপর ৩ এপ্রিল পরিবারের সকল সদস্যসহ শেরেবাংলা নগরে নিয়ে তাঁকে সংসদ সদস্য ভবনের সেনাক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর তাঁর আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।

তাঁর স্ত্রী সুরাইয়া ইসলামের ‘আমার স্বামী’ রচনা থেকে এ সম্পর্কে তথ্য জানা যায়। তিনি লিখেছেন, ‘২৫ মার্চে ঢাকা শহর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাঙালি নিধনযজ্ঞ সংঘটিত হয়ে গেছে, আমরা সবাই আতঙ্কের মধ্যে দিনযাপন করছি।

এমনি সময় ২৯ মার্চ বেলা ১১টার দিকে হঠাৎ শুনলাম প্রচুর গোলাগুলির আওয়াজ। জয়দেবপুরে জনসাধারণের ওপর বোমাবর্ষণ শুরু হয়।

আতঙ্কিত হয়ে পড়ে সমরাস্ত্র কারখানার সব বাঙালি কর্মচারী। ডাক্তার সাহেব বললেন, যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। যদি পারো তো তোমরা গ্রামে চলে যাও।...আমি বললাম, “মেয়েদের নিয়ে আমি কোথায় যাবো?

মরতে হয় এখানেই মরবো।”...ঐদিনই প্রায় ৩টার দিকে অসংখ্য খানসেনা রাইফেল হাতে আমাদের বাড়ি ঘিরে ফেলে এবং লাথি মেরে বাসার দরজা ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকে পড়ে।...আমাদের চোখের সামনেই পুরুষদের নিয়ে গেল আর বাইরে গোলাগুলির শব্দের প্রচণ্ডতা।

সে কী ভয়াবহ অবস্থা। তা লিখে বোঝানো যাবে না। ২৯ মার্চ থেকে ২ এপ্রিল পর্যন্ত বারবার তাদের বাইরে নিয়ে যেত।

ডাক্তার সাহেবকে জিগ্যেস করে কিছুই জানা যেত না, শুধু বলতেন কথাবার্তা জিগ্যেস করে।...

‘৩ এপ্রিল সকালে নামাজ পড়ে তিনি বললেন, “একটা সুটকেসে তোমাদের কিছু কাপড় নিয়ে নাও।’ জানতে চাইলাম, ‘তোমারটা নেবে না?”

বললেন, “দরকার নেই।” কথাটা ঠিক বুঝতে পারিনি, আজ উপলব্ধি করি।...সকাল ৯-১০টা হবে, একটি বড় বাস এসে দাঁড়ালো, সেটাতে নিয়ে যাবে সবাইকে।...দীর্ঘদিন পর বন্দী অবস্থা থেকে বাইরে এলাম।

ঢাকা শহর থমথমে—স্তব্ধ প্রায়; কেমন যেন বিভীষিকাময়, কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি। আশায় বুক বেঁধে আছি, ফার্মগেটে আমাদের নামিয়ে দেবে, তারপর মুক্তি।

কিন্তু না, ফার্মগেট নয়, আমাদের আনা হলো সেকেন্ড ক্যাপিটালে। আমরা পৌঁছানোর একটু পরেই একজন সিপাহি এসে বাঙালি পুরুষদের সবাইকে ভেতরে ডেকে নিয়ে যান।

এটাই তাঁর সাথে শেষ দেখা—তিনি চিরতরে হারিয়ে গেলেন আমার জীবন থেকে।’ (মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ, প্রথম প্রকাশ ২০০৯, বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ)।

নইমুল ইসলামের জন্ম ১৯২৫ সালের ২৯ নভেম্বর দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুরে। বাবা নুরুল হুদা ও মা ফাতেমা খাতুন।

সাত ভাই ও এক বোন। মেধাবী ছাত্র ছিলেন। অঙ্কে কখনো এক শর নিচে নম্বর পাননি। শিক্ষাজীবনে তিনি বিভিন্ন বৃত্তি ও স্কলারশিপ পেয়েছেন।

ঠাকুরগাঁও হাইস্কুল থেকে প্রথম বিভাগে ডিস্টিংশন নিয়ে ম্যাট্রিক (১৯৪০) এবং কলকাতা থেকে প্রথম বিভাগে ইন্টারমিডিয়েট (১৯৪২) পাস করেন।

১৯৫০ সালে কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাস করে ওই বছরেই তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেডিকেল কোরে যোগ দেন।

১৯৫০ থেকে ১৯৬৪ পর্যন্ত পাকিস্তান নৌবাহিনীতে ডেপুটেশনে ছিলেন। ১৯৬৮ সালের জুন মাসে চট্টগ্রামে বদলি হয়ে আসেন।

১৯৭০ সালের অক্টোবরে গাজীপুর সমরাস্ত্র কারখানায় চিকিৎসক নিযুক্ত হন। তখন তাঁর পদবি ছিল মেজর।

তিনি দুই মেয়ে ও এক ছেলের জনক। মেয়ে নাদেরা ইসলাম ও নুসরাত ইসলাম। তাঁরা দুজনই প্রবাসী। ছেলে মইনুল ইসলাম। দেশে থাকেন। ব্যবসায়ী।

স্কেচ: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (চতুর্থ পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯৫) থেকে।

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান

<[email protected]>

সূত্র: ১৩ ফেব্রুয়ারি , ২০১৫ সালে প্রথম আলোতে প্রকাশিত