বিজ্ঞাপন
default-image

চিকিৎসক, শিক্ষানুরাগী, সমাজসেবী ও রাজনীতিবিদ হিসেবে জিকরুল হক সৈয়দপুরে খ্যাতিমান ছিলেন।

সৈয়দপুর উচ্চবিদ্যালয়ের সেক্রেটারি, সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক ও সৈয়দপুর পৌরসভার প্রথম চেয়ারম্যান হিসেবে তাঁর অবদান এখনো স্মরণযোগ্য।

সৈয়দপুরের ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ‘শিল্প সাহিত্য সংসদ’-এর সভাপতি ছিলেন তিনি। সৈয়দপুর জামে মসজিদের উন্নয়নমূলক কাজেও তিনি জড়িত ছিলেন।

একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতেই সৈয়দপুর সেনানিবাসে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাদের একটি দল জিকরুল হককে তাঁর নতুন বাবুপাড়ার বাড়ি থেকে ধরে সেনানিবাসে নিয়ে যায়। এরপর তাঁর আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।

রাজনীতিতে নিবেদিতপ্রাণ জিকরুল হক পাকিস্তানের ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগের এমপিএ (মেম্বার অব প্রভিনশিয়াল অ্যাসেম্বলি) নির্বাচিত হয়েছিলেন।

তাঁর নির্বাচনী এলাকা ছিল অবাঙালি-অধ্যুষিত। তা সত্ত্বেও তিনি বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছিলেন—মূলত জনসেবা, শিক্ষা বিস্তার ইত্যাদি কাজে জড়িত থাকার কারণে।

সত্তরের নির্বাচনের আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সৈয়দপুরে গেলে জনসভায় তাঁর উপস্থিতিতেই তিনি বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ যদি ক্ষমতায় যায় এবং বঙ্গবন্ধু যদি জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে না পারেন, তাহলে তাঁর বিরুদ্ধেই দুর্বার গণ-আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।’

সাহসও ছিল তাঁর বিরাট সম্পদ। পাকিস্তান শাসনামলে একজন অবাঙালি ম্যাজিস্ট্রেটের সহায়তায় স্থানীয় অবাঙালিরা সৈয়দপুর উচ্চবিদ্যালয় কুক্ষিগত করার অপচেষ্টা করে। তারা চেষ্টা করেছিল ওই বিদ্যালয়টি বাঙালিমুক্ত রাখার। তাদের এই চক্রান্ত তিনি নস্যাৎ করে দিয়েছিলেন।

জিকরুল হকের ডাক্তারখানায় যেসব লোক আসতেন তাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন গরিব। তিনি তাঁদের কাছ থেকে কখনো ফি নেননি। যাঁদের সামর্থ্য ছিল, তাঁদের কাছ থেকেও কখনো ফি চেয়ে নেননি। তাঁরা যা দিয়েছেন, তা-ই নিয়েছেন।

জিকরুল হকের জন্ম ১৯১৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর, সৈয়দপুরে। তাঁর আদি পৈতৃক নিবাস দিনাজপুর জেলার চিরিরবন্দর উপজেলার পলাশবাড়ীতে।

বাবা শেখ জিয়ারতউল্লাহ আহমদ, মা খমিউননেছা চৌধুরাণী। চার ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়।

১৯৩৩ সালে সৈয়দপুর উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন।

১৯৩৯ সালে কলকাতার ক্যাম্বেল মেডিকেল স্কুল থেকে এলএমএফ পাস করেন। মেডিকেল স্কুলে পড়ার সময় সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। কলকাতার জীবন শেষ করে সৈয়দপুরে ফিরে চিকিৎসা পেশায় মনোনিবেশ করেও রাজনীতি থেকে সরে যাননি।

১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছিলেন।

জিকরুল হক নয় ছেলে ও দুই মেয়ের জনক। ছেলে মো. বখতিয়ার কবির, মো. এনামুল হক, মো. মাহবুবুল হক, মো. জিয়াউল হক, মো. এমদাদুল হক, মো. মোনায়েমুল হক, মো. মফিজুল হক, মো. মাহফুজুল হক ও মো. মাহমুদুল হক। মেয়ে জেবুন নাহার ও ফাতেমা আক্তার। স্ত্রী আজিজা খাতুন।

মুক্তিযুদ্ধকালে জিকরুল হকের আপন দুই ভাই জহুরুল হক ও আমিনুল হক এবং ভাইপো কুদরত-ই-এলাহীসহ আরও কয়েকজন আত্মীয় শহীদ হন।

তাঁর দুই ভাইয়ের একজনকে জুন মাসের মাঝামাঝি এবং আরেকজনকে ১৪ ডিসেম্বর অবাঙালিরা হত্যা করে।

স্বাধীনতার পর সৈয়দপুরের প্রধান সড়কের নামকরণ হয় তাঁর নামে। কয়েক বছর পর পৌর পাঠাগারের নাম তাঁর নামে করা হয়। ২০০১ সালে তাঁকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক প্রদান করা হয়।

জিকরুল হকের জ্যেষ্ঠ সন্তান বখতিয়ার কবির এ প্রতিবেদককে জানান (২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫), তাঁর বাবাকে শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও সরকারের কাছ থেকে অফিশিয়াল কোনো কাগজপত্র তাঁরা পাননি।

স্কেচ: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (তৃতীয় পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯৪) থেকে।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
[email protected]

সূত্র: ৮ ফেব্রুয়ারি , ২০১৫ সালে প্রথম আলোতে প্রকাশিত