বিজ্ঞাপন
default-image

চোখ বেঁধে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় শিক্ষক জিতেন্দ্র নাথ সরকারকে। এরপর তাঁকে হত্যা করে আত্রাই নদে লাশ ভাসিয়ে দেয় পাকিস্তানি হানাদার সেনারা।

পাহাড়পুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক জিতেন্দ্র নাথ সরকার এলাকায় সজ্জন, নীতিমান ও প্রগতিশীল মানুষ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার সফাপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ তাঁকে আন্দোলিত করে। তখন থেকেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে এলাকার তরুণদের সংগঠিত করতেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তরুণদের ভারতের বালুরঘাট ও পারিলা প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে দিয়ে এসেছেন।

একাত্তরের ৩০ এপ্রিল জিতেন্দ্র নাথ সরকারের বাড়িতে লুটপাট করে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে তাঁকে চোখ বেঁধে নিয়ে যায় হানাদার সেনারা। এরপর থেকে তাঁর আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। স্বজনেরা পরে জানতে পারেন, মহাদেবপুর ডাকবাংলোয় পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন করে জিতেন্দ্র নাথকে হত্যা করে লাশ আত্রাই নদে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে।

শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে তথ্য চেয়ে প্রথম আলোতে বিজ্ঞাপন ছাপা হলে শহীদ জিতেন্দ্র নাথ সরকারের বিষয়ে তথ্য ও ছবি পাঠান নওগাঁর স্থানীয় সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন একুশে পরিষদ নওগাঁর সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা-আল-মেহমুদ। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে তরুণ এই গবেষকের মাঠপর্যায়ের গবেষণাগ্রন্থ রক্তঋণ ১৯৭১: নওগাঁ জিতেন্দ্র নাথ সরকার সম্পর্কে তথ্য রয়েছে। তাঁর দেওয়া তথ্যসূত্র ধরে অনুসন্ধান করা হয়।

শহীদ জিতেন্দ্র নাথ সরকারের জন্ম ১৯৪০ সালের ২৩ জুন নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার পাহাড়পুর গ্রামে। বাবা দ্বারকানাথ সরকার ছিলেন পাহাড়পুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হেড পণ্ডিত। মা বিরজা বালা সরকার। তাঁদের পাঁচ সন্তানের মধ্যে জিতেন্দ্র নাথ ছিলেন চতুর্থ। তিনি মহাদেবপুর সর্বমঙ্গলা উচ্চবিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাস করে পাহাড়পুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। তিনি বিয়ে করেননি।

জিতেন্দ্র নাথকে ধরে নিয়ে যাওয়ার স্মৃতিচারণা করে ছোট বোন বিরজা বালা প্রথম আলোকে বলেন, ‘সেদিন ভোরে পাকিস্তানি সেনারা আমাদের বাড়িতে হানা দেয়। সদর দরজায় বারবার আঘাতের শব্দ পেয়ে বাবা দরজা খুলে দেন। তারা বাড়িতে ঢুকেই দাদাকে খুঁজতে শুরু করে। মা-বাবার সামনেই তাঁকে ধরে চোখ বেঁধে নিয়ে যায়। মা-বাবা তাঁকে ছেড়ে দিতে অনেক আকুতি করলেও বর্বর সেনারা শোনেনি।’

শিক্ষক জিতেন্দ্র নাথের ছাত্র ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদ মহাদেবপুর উপজেলা ইউনিটের সাবেক কমান্ডার মহসীন আলী। তিনি বলেন, ‘স্যারের উৎসাহেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ হই। তিনি নিজে আমাকেসহ ছয়জনকে একাত্তরের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে যুদ্ধের প্রশিক্ষণের জন্য ভারতের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার পারিলা ক্যাম্পে দিয়ে আসেন। পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে।’

মহাদেবপুর উপজেলার পাহাড়পুরে ১৯৮৪ সালে শহীদ জিতেন্দ্র নাথ সরকার স্মরণে ‘পাহাড়পুর জিতেন্দ্র নাথ বালিকা উচ্চবিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করা হয়।

গ্রন্থনা: ওমর ফারুক, নওগাঁ।