বাসায় সেই রাতে একা ছিলেন রংপুর কারমাইকেল কলেজের গণিত বিভাগের অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন রায়। হানাদার পাকিস্তানি সেনারা এসে ঘুম থেকে ডেকে তোলে তাঁকে। নিয়ে যায় শহর থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের পাশে দমদমা সেতুর কাছে। নিরপরাধ এই শিক্ষককে গুলি করে হত্যা করে তারা। এখানেই তাঁর মরদেহ পাওয়া যায়। সেদিন ছিল একাত্তরের ৩০ এপ্রিল।
রংপুরে মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার বিষয় নিয়ে গবেষণা করেছেন কারমাইকেল কলেজের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মতিয়ার রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন রায় থাকতেন ক্যাম্পাসের পশ্চিম দিকে অবস্থিত ১৪ নম্বর আবাসিক বাসভবনে। ঘটনার দিন স্ত্রী কনক প্রভা রায় ও দুই শিশুসন্তান বাসায় ছিল না। দেশের পরিস্থিতি খারাপ বুঝতে পেরে তিনি স্ত্রী–সন্তানদের গ্রামের বাড়ি পিরোজপুর জেলার নন্দীপাড়ার বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। তাঁর দুই সন্তানের মধ্যে ওই সময় ছেলে চঞ্চল রায়ের বয়স ছিল প্রায় দুই বছর। আর মেয়ে সুপর্ণা রায়ের এক বছর। এখন তাঁরা কেউ এখানে থাকেন না। চঞ্চল রায় ভারতের কলকাতায় বসবাস করছেন। আর সুপর্ণা রায় যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী।
গবেষক মতিয়ার রহমান আরও বলেন, অধ্যাপক রায়কে ওই রাতে গুলি করে হত্যার সময় দমদমা এলাকার লোকজন দূর থেকে ঘটনাটি দেখেছেন। এখানে আরও অনেককে হত্যা করা হয়েছিল। ঘাতক পাকিস্তানি সেনারা চলে যাওয়ার পর এলাকার কৌতূহলী লোকজন ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়ে মরদেহ দেখেছেন। তাঁদের কেউ কেউ চিত্তরঞ্জন রায়কে চিনতেও পেরেছিলেন। পরে তাঁরা কারমাইকেল কলেজ ক্যাম্পাসে গিয়ে শিক্ষকদের বিষয়টি জানান। বাংলা একাডেমির শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থে রংপুর কারমাইকেল কলেজের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে চিত্তরঞ্জন রায়ের নামও উল্লেখ রয়েছে।
শহীদ শিক্ষক অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন রায়ের জন্ম ১৯৩৯ সালের ৫ ডিসেম্বর। বাবা রতিকান্ত রায়, মা সুরুবালা রায়। চিত্তরঞ্জন ১৯৫৪ সালে মাধ্যমিক পাস করেন বাগেরহাট জেলার কচুয়া থানার আন্ধারমানিক হাইস্কুল থেকে। এরপর একই জেলার পিসি কলেজ থেকে ১৯৫৬ সালে উচ্চমাধ্যমিক, ১৯৫৮ সালে স্নাতক এবং ১৯৬১ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত বিষয়ে স্নাতকোত্তর করেন। গণিতের শিক্ষক হিসেবে তিনি প্রথম শিক্ষকতা জীবন শুরু করেছিলেন মুন্সিগঞ্জের হরগঙ্গা কলেজে। এরপর ১৯৬৬ সালে কারমাইকেল কলেজে গণিত বিভাগে যোগ দেন।
গবেষক মতিয়ার রহমান আরও জানান, অধ্যাপক রায় বিদ্যোৎসাহী মানুষ ছিলেন। এলাকার অনেক দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীর পড়ালেখার খরচ দিতেন তিনি। তাঁর স্মৃতি রক্ষার জন্য তাঁর গ্রামের বাড়ি পিরোজপুরের নন্দীপাড়া এলাকায় পরিবার ও এলাকাবাসীর উদ্যোগে সেখানে একটি পাঠাগার ও ক্লাব স্থাপন করা হয়েছে।
এ ছাড়া কারমাইকেল কলেজের প্রশাসনিক ভবনের সামনে নির্মিত শহীদ স্মৃতিস্তম্ভের নামফলকেও চিত্তরঞ্জন রায়ের নাম রয়েছে। তবে তাঁকে যেখানে হত্যা করা হয়েছিল দমদমার সেই বধ্যভূমি অযত্ন–অবহেলায় পড়ে আছে। একসময় এখানে একটি নামফলক লাগানো হলেও সেটি আর নেই। এলাকার সুধীজন অনেক দিন থেকে এই বধ্যভূমি সংরক্ষণের দাবি করে আসছেন।
গ্রন্থনা: আরিফুল হক, রংপুর