বিজ্ঞাপন
default-image

শিক্ষানুরাগী খন্দকার মো. এলাহী বক্স ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করতেন। সাহিত্যচর্চাও করতেন। তাঁর গ্রামের বাড়ি গাজীপুর জেলার কাপাসিয়ায়। নানা জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে ১৯৫১ সালে তিনি এসেছিলেন ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু উপজেলার ভাদড়া গ্রামে। তারপর সেখানেই স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় একটি স্কুল খুলে গ্রামের শিশুদের পড়ালেখা শেখানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে গ্রামের তরুণদের উদ্বুদ্ধ করেছিলেন যুদ্ধে যাওয়ার জন্য। রাজাকার আর পাকিস্তানি ঘাতক সেনারা তাঁকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে বাড়ির পাশেই বিলের পাড়ে হত্যা করে।

শহীদ খন্দকার মো. এলাহী বক্সের সংক্ষিপ্ত জীবনী রয়েছে বাংলা একাডেমির শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ গ্রন্থে। তবে সেখানে খুব বেশি তথ্য নেই, উল্লেখ করা হয়েছে তিনি মাধ্যমিক পাস ছিলেন। তাঁর স্ত্রী আনোয়ারা খাতুন চার বছর আগে ইন্তেকাল করেছেন। তাঁর দুই মেয়ে। বড় মেয়ে মমতাজ খাতুন অসুস্থ। ছোট মেয়ে পারভিনা খাতুনের স্বামী ফজলুর রহমান ঝিনাইদহ পৌরসভার চরমুরারিদহ এলাকায় থাকেন। তিনি প্রথম আলোকে জানান, শহীদ খন্দকার মো. এলাহী বক্স ঝিনাইদহে এসে হেলাল উদ্দিন নামের এক শিক্ষানুরাগীর বাড়িতে উঠেছিলেন। সে সময় গ্রামে শিক্ষিত মানুষ বেশি ছিল না। এলাহী বক্স গ্রামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে সেখানেই শিক্ষকতা শুরু করেন। এখানেই আতোর আলীর কন্যা আনোয়ারা খাতুনের প্রেমে পড়ে যান তিনি। হেলাল উদ্দিনের মাধ্যমে বিয়ের প্রস্তাব দেন এবং তাঁদের বিয়ে হয়ে যায়।

ফজলুর রহমান জানান, শাশুড়ি আনোয়ারা খাতুনের কাছ থেকে তিনি শুনেছেন, বিয়ের এক বছর পর তাঁদের প্রথম মেয়ে মমতাজ খাতুনের জন্ম হয়। মেয়ের বয়স যখন মাত্র চার মাস, তখন সবাইকে ফেলে এলাহী বক্স হঠাৎ একদিন নিরুদ্দেশ হয়ে যান। কোথায় যান, তা কেউ কখনো বুঝতে বা জানতে পারেননি। ১৯৬৬ সালের ১ জানুয়ারি তিনি আবার ভাদড়া গ্রামে ফিরে আসেন। তখন তাঁর রেখে যাওয়া মেয়ে তাঁকে চিনতে পারেনি। স্ত্রী আনোয়ারার মনে হয় যেন তিনি আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছেন। ফিরে এসে এলাহী বক্স আবার শিক্ষকতা ও সাহিত্যচর্চায় উৎসাহী হয়ে ওঠেন। এক যুগ পর নামে আত্মজীবনীমূলক একটি উপন্যাস লেখেন, এটি ছাপাও হয়েছিল। তাঁদের সংসারে আসে দ্বিতীয় মেয়ে। নাম রাখেন পারভিনা খাতুন।

ফজলুর রহমান জানান, তাঁর শ্বশুর এলাহী বক্স প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষকতা ও সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি এলাকার মানুষকে শিক্ষিত করে গড়ে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি তরুণদের মুক্তিযুদ্ধে যেতে উৎসাহিত করেন। নানাভাবে সহায়তা করেন মুক্তিযোদ্ধাদের। যে কারণে একাত্তরের ৭ মে ভোররাতে স্থানীয় রাজাকাররা একদল হানাদার পাকিস্তানি ঘাতক সেনাকে সঙ্গে এনে বাড়ি ঘিরে ফেলে। তারা খন্দকার মো. এলাহী বক্সকে তুলে নিয়ে যায়। এরপর তাঁর আর কোনো খবর পাওয়া যায়নি। পরে তাঁরা শুনেছেন, গ্রামের পাশেই হুমাদার বিলে নিয়ে গিয়ে এলাহী বক্সকে হত্যা করা হয়েছিল। তিনি বলেন, তাঁর শাশুড়ি স্বামীর কবর দেখার জন্য প্রায়ই কান্নাকাটি করতেন। কিন্তু এলাহী বক্সের লাশ পাওয়া যায়নি বলে কোথায় তাঁকে কবর দেওয়া হয়েছিল জানা সম্ভব হয়নি।

ফজলুর রহমানের ছেলে কলেজছাত্র পারভেজ আহম্মেদ জানান, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবার হিসেবে তাঁরা সরকারি মাসিক ভাতা পেতেন, কিন্তু ১৯৮৪ সাল থেকে ভাতা বন্ধ হয়ে গেছে। কেন বন্ধ হয়েছে, তা তাঁরা জানতে পারেননি।

গ্রন্থনা: আজাদ রহমান, ঝিনাইদহ