বিজ্ঞাপন
default-image

পরিচয়পত্রের জন্য ছবি তোলার কথা বলে সিলেটের তারাপুর চা-বাগানের মেডিকেল অফিসার ক্ষিতিশ চন্দ্র দে, বাগানমালিক রবীন্দ্র লাল গুপ্তের পরিবারের পুরুষ সদস্য ও কর্মচারী মিলিয়ে ৪১ জনকে পাকিস্তানি হানাদার সেনারা পাশের মালনীছড়া চা-বাগানে নিয়ে নির্যাতন করে। সেখানে সেনাদের গুলিতে ৩৯ জন শহীদ হন।

এই গণহত্যা ঘটেছিল একাত্তরের ১৮ এপ্রিল। পাকিস্তানি বাহিনীর প্রায় ৫০ জনের একটি দল তারাপুর চা-বাগানের কর্মচারীদের আবাসন ও বাংলো ঘিরে ফেলে। ছবি তোলার কথা বলে তারা সবাইকে বাংলোর একটি কক্ষে ডেকে আনে। তাঁদের মধ্যে বাগানের মালিক দুই সহোদর রবীন্দ্র গুপ্ত ও রাজেন্দ্র গুপ্ত, তাঁদের পরিবারের কয়েকজন পুরুষ সদস্য, চিকিৎসক ক্ষিতিশ চন্দ্র দে এবং বাগানের পুরুষ কর্মকর্তা-কর্মচারী ছিলেন। পরে ঘাতকেরা তাঁদের মালনীছড়া চা-বাগানের একটি জায়গায় এনে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি চালায়। তবে সদানন্দ ও গণেশ হালদার নামের দুই শ্রমিক বেঁচে যান। শহীদ হন ৩৯ জন। পরদিন সকালে সদানন্দ ও গণেশ ফিরে এসে সবাইকে ঘটনা খুলে বলেন। এরপর সবাই বাগান ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে ছোটেন। মৃত ব্যক্তিদের সেখানেই গণকবরে মাটিচাপা দেওয়া হয়। যুদ্ধের পর শহীদদের স্মরণে বাগানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। গণহত্যার পর ক্ষিতিশ দের স্বজনেরা শরণার্থী হিসেবে ভারতে আশ্রয় নেন। এরপর স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি বাহিনী বাগানের বাংলো লুট করে। এ সময় আরও কয়েকজনকে তারা গুলি করে হত্যা করে। বিজয় অর্জনের পর ক্ষিতিশের স্বজনেরা স্বাধীন দেশে ফিরে আসেন।

ক্ষিতিশ চন্দ্র দের বাড়ি মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার কাদিপুর ইউনিয়নের ছকাপন গ্রামে। ১৯২০ সালের ২৮ ডিসেম্বর তাঁর জন্ম। বাবা জগৎ চন্দ্র দে ছিলেন স্কুলশিক্ষক। মা কুমুদিনী দে গৃহিণী। পাঁচ ভাই ও এক বোনের মধ্যে ক্ষিতিশ ছিলেন তৃতীয়। তাঁর দুই মেয়ে ও এক ছেলে। তাঁরা অনেক আগেই গ্রামের বাড়ির ভিটেমাটি, জমিজমা বিক্রি করে সিলেট নগরের করেরপাড়া এলাকায় বাড়ি করে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। তাঁদের মা নিভা রানী দে বেঁচে আছেন, বয়স ৯৫।

আগামী প্রকাশনীর শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থে ক্ষিতিশ চন্দ্র দের জীবনী রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বিভিন্ন গ্রন্থেও শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে ক্ষিতিশ চন্দ্র দের নাম উল্লেখ রয়েছে।

ছেলে অসিত বরণ দের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি স্নাতক শ্রেণিতে পড়তেন। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চিঠি দিয়ে তাঁর পরিবারকে সমবেদনা জানিয়েছিলেন। চিঠির সঙ্গে রাষ্ট্রপতি তহবিল থেকে দুই হাজার টাকা পাঠিয়েছিলেন। চিঠিটি তাঁদের কাছে সংরক্ষিত আছে। এ ছাড়া তখন ঢাকায় একটি অনুষ্ঠানে তাঁদের আমন্ত্রণ জানিয়ে ক্রেস্ট দেওয়া হয়েছিল। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে এখন পর্যন্ত তাঁরা শহীদ পরিবারের স্বীকৃতি পাননি।

গ্রন্থনা: কল্যাণ প্রসূন, জুড়ী, মৌলভীবাজার