বিজ্ঞাপন
default-image

রাত থেকেই তুমুল যুদ্ধ চলছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে। কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের হোসেনাবাদ গ্রামে একাত্তরের ৭ ডিসেম্বর বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধাদের দল যখন মেতে উঠেছেন বিজয়োল্লাসে, তখন কে এম রফিকুল ইসলামের বুকের রক্তে ভেসে যাচ্ছে সবুজ ঘাস। সহযোদ্ধারা দেখলেন নিথর হয়ে গেছে তাঁর শরীর। নিমেষে তাঁদের আনন্দ পরিণত হলে বিষাদে।

হোসেনাবাদে (আগের নাম হরিশংকর) হানাদার পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ শুরু হয়েছিল ৬ ডিসেম্বর দিবাগত রাতেই। প্রায় সারা রাতই চলে প্রচণ্ড গোলাগুলি। ভোরের দিকে পরাজয় মেনে পিছু হটতে থাকে হানাদারের দল। তখনো আলো ভালো করে ফোটেনি। এ সময় হানাদারদের একটি গুলি এসে লাগে বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রকৌশলী কে এম রফিকুল ইসলামের বুকে। সঙ্গে সঙ্গেই নিভে যায় তাঁর জীবনপ্রদীপ। কিন্তু সহযোদ্ধারা তাৎক্ষণিকভাবে তাঁর শহীদ হওয়ার বিষয়টি জানতে পারেননি। দিনের আলো ফুটলে মুক্তিযোদ্ধারা যখন জয়ের আনন্দে মেতে উঠেছেন, তখন তাঁরা রফিকুল ইসলামের নিথর দেহটি দেখতে পান। জীবন দিয়ে তরুণ রফিকুল শত্রুমুক্ত করে যান ভারতীয় সীমান্তবর্তী কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুর উপজেলাকে। পরে তাঁকে মরণোত্তর বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। তিনি ছিলেন অবিবাহিত।

শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তথ্য চেয়ে প্রথম আলোতে বিজ্ঞাপন ছাপা হলে মেহেরপুর সরকারি কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক আবদুল্লাহ আল-আমিন শহীদ কে এম রফিকুল ইসলামের ছবি ও তাঁর কর্মজীবন নিয়ে বিস্তারিত তথ্যসমৃদ্ধ লেখা পাঠান। সেই সূত্র ধরে অনুসন্ধান করা হয়।

শহীদ কে এম রফিকুল ইসলামের জন্ম ১৯৪৫ সালে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলার গোলাপনগর গ্রামে। রফিকুল ইসলাম ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে ১৯৭১ সালে গঙ্গা-কপোতাক্ষ প্রকল্পের যান্ত্রিক শাখায় উপসহকারী প্রকৌশলী হিসেবে পেশাগত জীবন শুরু করেন।

রফিকুল ইসলাম ছিলেন বহু গুণের অধিকারী। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি অ্যাথলেটিকে পারদর্শী ছিলেন। এলাকায় অনেক যাত্রাপালায় তিনি অভিনয় ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে লোকসংগীত পরিবেশন করেছেন।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে একাত্তরের এপ্রিলে রফিকুল ইসলাম সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়ার চাকুলিয়ায় যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন। সেখান থেকে ফিরে কর্নেল আবু ওসমান চৌধুরীর নেতৃত্বে ৮ নম্বর সেক্টরে যোগ দেন। বৃহত্তর কুষ্টিয়ার বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের সহযোগী রাজাকারদের বিরুদ্ধে গেরিলা ও সম্মুখযুদ্ধে সাহসিকতার পরিচয় দেন।

শহীদ রফিকুল ইসলাম চূড়ান্ত বিজয় দেখে যেতে পারেননি। তাঁর সহযোদ্ধারা ৭ ডিসেম্বর গ্রামবাসীর সহায়তায় দৌলতপুরের তারাগুনিয়া গ্রামে তাঁকে দাফন করেন। শহীদ রফিকুল ইসলামের পৌরুষদীপ্ত এই আত্মত্যাগের কথা দ্রুত এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর এই আত্মত্যাগ মিরপুর ও ভেড়ামারা এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করে। অচিরেই প্রবল যুদ্ধে তাঁরা মিরপুর ও ভেড়ামারা হানাদারমুক্ত করেন।

কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসনের ওয়েবসাইটে এবং জনতা ব্যাংক লিমিটেড থেকে প্রকাশিত স্মারকগ্রন্থ একাত্তরের বীরযোদ্ধাদের অবিস্মরণীয় জীবনগাথায় শহীদ কে এম রফিকুল ইসলামকে দেশমাতৃকার বীর সন্তান হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।

ড. মো. আবদুল হান্নানের লেখা স্বাধীনতাযুদ্ধে বৃহত্তর কুষ্টিয়া বইয়েও শহীদ রফিকুল ইসলামের বীরোচিত আত্মত্যাগের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। শহীদ রফিকুল ইসলামের স্মৃতি রক্ষার্থে কুষ্টিয়ার তারাগুনিয়ায় তাঁর নামে ‘শহীদ কে এম রফিকুল ইসলাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শহীদ রফিকুলের মাকে সমবেদনা জানিয়ে চিঠি দিয়েছিলেন।

রফিকুল ইসলামের ছোট ভাই পানি উন্নয়ন বোর্ডের অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী কে এম রাকিবুল ইসলাম বলেন, দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে তাঁর ভাই জীবন উৎসর্গ করেছেন। তাঁর বীরোচিত আত্মদানের জন তাঁদের পরিবার গর্ব অনুভব করে।

গ্রন্থনা: আবু সাইদ, মেহেরপুর