বিজ্ঞাপন
default-image

রংপুর কারমাইকেল কলেজের অধ্যাপক কালাচাঁদ রায় ও তাঁর স্ত্রী মঞ্জুশ্রীকে রাতের আঁধারে তাঁদের কলেজ ক্যাম্পাসের বাসা থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে পাকিস্তানি ঘাতক সেনারা হত্যা করে। কলেজ থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের পাশে দমদমা সেতুর কাছে তাঁদের লাশ পাওয়া যায়। সেদিন ছিল একাত্তরের ৩০ এপ্রিল।

রংপুরে একাত্তরের গণহত্যা নিয়ে গবেষণা করেছেন কারমাইকেল কলেজের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মতিয়ার রহমান। তিনি প্রথম আলোকে জানান, রসায়নের অধ্যাপক কালাচাঁদ রায় ক্যাম্পাসের পূর্ব দিকে ৬ নম্বর আবাসিক বাসভবনে থাকতেন। ঘটনার রাত আনুমানিক সাড়ে ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে পাকিস্তানি সেনারা তাঁর বাড়িতে হানা দেয়।

অধ্যাপক কালাচাঁদ রায়কে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর স্ত্রী মঞ্জুশ্রী বাধা দিয়েছিলেন। ঘাতকেরা তাঁকেও তুলে নিয়ে যায়। এ সময় বাড়িতে ছিল তাঁদের দুই শিশুসন্তান তিন বছরের ভাস্বতী রানী আর দেড় বছরের সুমন কুমার। তুলে নিয়ে যাওয়ার আগে মঞ্জুশ্রী হয়তো ছেলেকে খাওয়ানোর জন্য দুধ তৈরি করছিলেন। পরদিন সকালে ঘরের মেঝেতে দুধের ফিডারটি পড়ে থাকতে দেখা যায়। আর ছোট্ট দুই শিশু কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়েছিল। তারা বুঝতেই পারেনি একদল নরপশু বাবা-মাকে তাদের কাছ থেকে চিরতরে কেড়ে নিয়ে গেছে।

গবেষক মতিয়ার রহমান জানান, দমদমা এলাকার কিছু লোক আড়াল থেকে অধ্যাপক কালাচাঁদ রায় ও মঞ্জুশ্রীকে গুলি করে হত্যার দৃশ্য দেখেছেন। তাঁদের একজন চাল বিক্রেতা, যিনি কারমাইকেল কলেজ ক্যাম্পাসে চাল বিক্রি করতেন। ঘাতক সেনারা চলে যাওয়ার পর তিনি ঘটনাস্থলে গিয়ে কালাচাঁদ রায় ও তাঁর স্ত্রীকে চিনতে পারেন। রাতেই তিনি ক্যাম্পাসে এসে হত্যাকাণ্ডের খবর দেন। তবে রাতে ভয়ে কেউ বাসা থেকে বের হননি।

পরদিন ভোরে অনেকে অধ্যাপক কালাচাঁদ রায়ের বাসায় গিয়ে অবুঝ শিশু দুটিকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখেন। কলেজের গণিত বিভাগের অধ্যাপক রিয়াজউদ্দিন শিশু দুটিকে বুকে জড়িয়ে তাঁর বাসায় নিয়ে আসেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন কালাচাঁদ রায়ের দুই সন্তানকে তিনি ও তাঁর স্ত্রী নিজের সন্তানের মতোই লালনপালন করেন। দেশ স্বাধীনের পর কালাচাঁদ রায়ের বাবা শ্রী সুধীর কুমার রায় পুরো বিষয়টি জানতে পারেন। কালাচাঁদ রায়ের ছেলেমেয়েকে তাঁরা কুমিল্লায় তাঁদের বাড়িতে নিয়ে যান। এই দুই ভাইবোন এখন ভারতে বসবাস করছেন।

বাংলা একাডেমির শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ গ্রন্থে শহীদ অধ্যাপক কালাচাঁদ রায়ের সংক্ষিপ্ত জীবনী রয়েছে। কুমিল্লায় ১৯৪১ সালের ১০ এপ্রিল তাঁর জন্ম। আদর্শ শিক্ষক ছিলেন তিনি।

কারমাইকেল কলেজ চত্বরে কলেজের শহীদ শিক্ষক-কর্মচারীদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভে অধ্যাপক কালাচাঁদ রায়ের নাম রয়েছে। তবে এই অধ্যাপক দম্পতিকে যেখানে হত্যা করা হয়, সেই দমদমা বধ্যভূমি এখনো অরক্ষিত। বধ্যভূমির পাশের বাসিন্দা ফজলুল হক প্রথম আলোকে জানান, মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর বয়স ছিল ১৫ বছর। ওই রাতে তিনি লুকিয়ে থেকে এ হত্যাকাণ্ড দেখেছেন। হত্যাকাণ্ডের স্থানে একসময় শহীদ অধ্যাপকের নামে একটি নামফলক লাগানো হয়েছিল। সেটি আর নেই। বধ্যভূমিটি সংরক্ষণ করে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের জন্য সুধী মহলের দাবি অনেক দিনের।

গ্রন্থনা: আরিফুল হক, নিজস্ব প্রতিবেদক, রংপুর