বিজ্ঞাপন
default-image

করুণা কুমার চৌধুরী ছিলেন চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার জমিজুরির খ্যাতনামা এলএমএফ চিকিৎসক। বাড়িতেই ছিল তাঁর চেম্বারসহ বেশ বড় ডিসপেন্সারি। দূরদূরান্ত থেকে রোগীরা আসতেন। আবার প্রয়োজনে তিনি নিজেও সাইকেল চালিয়ে দূরের রোগী দেখতে যেতেন। গরিব রোগীদের বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা দিতেন তিনি।

সেদিন ছিল ১৯৭১ সালের ২৮ এপ্রিল। সকাল সাতটা পর্যন্ত জমিজুরি গ্রামের পরিবেশ ছিল শান্ত ও সুন্দর। নাশতা করে করুণা চৌধুরীর ছোট ছেলে নিরোদ চৌধুরী বাড়ি থেকে বের হয়ে যান। এর খানিক পর সকাল আটটার দিকে চন্দনাইশ উপজেলার (তৎকালীন পটিয়া থানা) দোহাজারী জমিজুরি গ্রামে রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তানি হানাদার সেনারা অতর্কিত হামলা করে গণহত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নিকাণ্ড ঘটায়।

হানাদারদের হামলার খবর পেয়ে করুণা কুমার চৌধুরী বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন ছেলে নিরোদকে খুঁজতে। বাড়ি থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে স্থানীয় সামাজিক সংগঠন জাগরণ ক্লাবের কাছে এলে তিনি পাকিস্তানি সেনাদলের সামনে পড়েন। রাস্তার পাশেই পুকুর পাড়ে তাঁকে দেখা মাত্র ঘাতক সেনারা গুলি করে হত্যা করে। এদিন ঘাতক সেনারা করুণা কুমার চৌধুরীসহ ৩ চিকিৎসক, ২ শিক্ষকসহ মোট ১৩ জন গ্রামবাসীকে হত্যা করেছিল।

শহীদ চিকিৎসক করুণা কুমার চৌধুরীর ছেলে সাবেক পুলিশ কনস্টেবল মিহির কান্তি চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রী মিনু চৌধুরী প্রথম আলোকে জানান, তাঁরা প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছে শোনেন, প্রথম গুলিতে তাঁর বাবা লুটিয়ে পড়ে যান। তারপর আবার ছেলে নিরোদের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে উঠে বসার চেষ্টা করেছিলেন। তখন ঘাতক সেনারা তাঁকে একাধিক গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করে। পরে নরপশুর দল এই হিন্দুপ্রধান গ্রামে ঢুকে পুরুষ যাঁকেই সামনে পেয়েছে, তাঁকেই গুলি করে হত্যা করে। ঘাতকের দল চলে গেলে গ্রামবাসী পরে গ্রামেই একটি স্থানে শহীদদের গণকবর দেন।

করুণা কুমার চৌধুরীর জন্ম ১৮৯৮ সালে জমিজুরি গ্রামে। তাঁর বাবা গণেশ চন্দ্র চৌধুরী এলাকার একজন খ্যাতনামা আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক ছিলেন। মা প্রভাবতী চৌধুরী গৃহিণী। তাঁদের তিন ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে করুণা কুমার সবার বড়। করুণা কুমার চট্টগ্রাম থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে কলকাতা থেকে চিকিৎসাশাস্ত্রে এলএমএফ ডিগ্রি নেন। তাঁর তিন ভাইয়ের মধ্যে নিবারণ চৌধুরী ও চিত্তরঞ্জন চৌধুরী ভারতে চাকরি করতেন। দেশভাগের পর তাঁরা ভারতেই থেকে যান। করুণা কুমারকেও তাঁরা ভারতে যেতে বলেছিলেন, কিন্তু জন্মভূমির প্রতি ছিল তাঁর গভীর ভালোবাসা। গ্রামে থেকেই স্বাধীনভাবে চিকিৎসক হিসেবে কাজ করছিলেন তিনি।

শহীদ করুণা কুমার চৌধুরীর চার ছেলে ও পাঁচ মেয়ে। তাঁর স্ত্রী ও এক মেয়ে মারা গেছেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান করুণা কুমার চৌধুরীর স্ত্রীর কাছে সমবেদনা জানিয়ে চিঠি ও দুই হাজার টাকার অনুদান পাঠিয়েছিলেন। এ ছাড়া এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশ: মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ–এর চতুর্থ খণ্ডে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক শামসুল আরেফিন জমিজুরি গ্রামের এই গণহত্যার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। সেখানে শহীদদের তালিকায় করুণা কুমার চৌধুরীর নাম আছে। গণহত্যার সহযোগী দুই অবাঙালিসহ ১৬ রাজাকারের নামও রয়েছে।

স্বাধীনতার পর করুণা কুমারসহ জমিজুরি গ্রামের শহীদদের বধ্যভূমিটি সংরক্ষণ করা হয়েছে। ১৯৭৫ সালে স্থানীয় সামাজিক সংগঠন জাগরণ ক্লাবের উদ্যোগে শহীদদের স্মরণে এখানে জাতীয় পতাকাখচিত একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। পরে চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ নতুন করে স্মৃতিসৌধ ও সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ করে। এখন এটি ‘জামিজুরি বধ্যভূমি’ নামে পরিচিত। স্মৃতিসৌধে শহীদ করুণা কুমার চৌধুরীর নাম রয়েছে।

করুণা কুমার চৌধুরীর পরিবারের আক্ষেপ, তাঁরা এখনো শহীদ পরিবার হিসেবে স্বীকৃতি পাননি, শহীদ বুদ্ধিজীবীর সরকারি তালিকাতেও করুণা কুমার চৌধুরীর নাম ওঠেনি।

গ্রন্থনা: আবদুর রাজ্জাক, পটিয়া, চট্টগ্রাম