রেলওয়ের যান্ত্রিক বিভাগের সহকারী প্রকৌশলী আবুল কাশেম মুক্তিযুদ্ধের সময় কর্মরত ছিলেন পাবনার ঈশ্বরদীর পাকশীতে। মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করায় পাকশীর অবাঙালিরা তাঁকে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে তুলে দেয়। নির্মম নির্যাতনে তাঁকে হত্যা করে লাশ পদ্মায় ফেলে দেওয়া হয়। পরিবার তাঁর লাশ পায়নি।
শহীদ প্রকৌশলী আবুল কাশেমের বাড়ি কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার সাহেবনগর গ্রামে। জন্ম ১৯২০ সালে। বাবা গোলাম হোসেন, মা পিয়ারা বেগম। তিনি পাঁচ ভাই ও তিন বোনের মধ্যে বড়। পাবনা জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে পাবনা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন। যন্ত্রপ্রকৌশল বিভাগ থেকে পাস করে যোগ দেন ব্রিটিশ রেলওয়েতে। তিনি ছিলেন এক ছেলে ও দুই মেয়ের বাবা। সন্তানেরা ছোট থাকতেই তাঁর স্ত্রী আশরাফুন্নেছা মারা যান। মুক্তিযুদ্ধের আগেই তিনি মেয়েদের বিয়ে দেন। ছেলে রেজাউল করিম ব্যবসায়ী। বড় মেয়ে শাহারা বানু গৃহিণী। অধ্যাপক হাসিনা বানু ছোট মেয়ে।
শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য চেয়ে প্রথম আলোতে বিজ্ঞাপন ছাপা হলে আবুল কাশেমের ছবি ও তথ্য পাঠান তাঁর মেয়ে বগুড়া আজিজুল হক কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক হাসিনা বানু। মুক্তিযুদ্ধের সময় আবুল কাশেম থাকতেন পাকশী রেলওয়ের সাহেবপাড়া কলোনিতে। পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ শুরুর আগেই পাবনার তৎকালীন জেলা প্রশাসক এম নূরুল কাদের প্রশিক্ষণের জন্য মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের ভারতে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। তাঁর নির্দেশে একাত্তরের ৮ এপ্রিল আবুল কাশেম নিজে একজন বাঙালি চালককে সঙ্গে করে বাঙালিদের নিয়ে একটি ট্রেন চালিয়ে ভারতের পোড়াদহ স্টেশনে যান ও তাদের নামিয়ে দিয়ে ট্রেনটি নিয়ে ফিরে আসেন। বিষয়টি পাকশীর রেলের অবাঙালি কর্মকতা–কর্মচারীরা ভালোভাবে নেননি। পাকিস্তানি সেনারা ১১ এপ্রিল পাকশীতে প্রবেশ করে। তারা হানাদার সেনাদের নিয়ে ওই দিনই প্রকৌশলী আবুল কাশেমের বাসভবন আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়। বিষয়টি জানতে পেরে আবুল কাশেম বাসা ছেড়ে পদ্মা নদী পার হয়ে কুষ্টিয়ার দরগাপাড়া গ্রামে আশ্রয় নেন। পরে বাড়িতে এসে মা–বাবার সঙ্গে দেখা করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
আবুল কাশেমের পরিকল্পনা ছিল, ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নেবেন। সে উদ্দেশে৵ জুনের প্রথম সপ্তাহে ভেড়ামারা রেলস্টেশনে যান। এক অবাঙালি ট্রেনচালক সেখানে তাঁকে চিনে ফেলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে ধরিয়ে দেন। পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে পাকশীর রূপপুরের ক্যাম্পে নিয়ে নির্মম নির্যাতন চালায়। পরে হার্ডিঞ্জ সেতুর কাছে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে লাশ পদ্মায় ফেলে দেয়।
হাসিনা বানু প্রথম আলোকে জানান, স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর দাদার কাছে সমবেদনা জানিয়ে চিঠি ও দুই হাজার টাকা অনুদান পাঠিয়েছিলেন। তিনি নানাভাবে খোঁজ নিয়ে বাবার শহীদ হওয়ার তথ্যগুলো সংগ্রহ করেছেন। ভেড়ামারা রেলস্টেশনে তাঁর বাবার এক সহকর্মী এবং পাকশী কাগজকলের এক কর্মকর্তা তাঁর বাবার আটক হওয়া ও নির্যাতনের তথ্য দিয়েছিলেন। তবে স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও তাঁর বাবা শহীদ হিসেবে সরকারি স্বীকৃতি পাননি।
বাংলাদেশ রেলওয়ের সাময়িকী রেল বাতায়ন–এ শহীদ কর্মকর্তা–কর্মচারীদের তালিকায় শহীদ প্রকৌশলী আবুল কাশেমের নাম রয়েছে। এ ছাড়া ঢাকায় কমলাপুর রেলস্টেশনে রেলের শহীদদের স্মৃতিফলকেও তাঁর নাম রয়েছে।
গ্রন্থনা: সরোয়ার মোর্শেদ, পাবনা