বিজ্ঞাপন
default-image

দুপুরের খাওয়াদাওয়া শেষে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন কাপ্তাইয়ের কর্ণফুলী পানিবিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রকৌশলী আবুল কালাম মোহাম্মদ শামসুদ্দীন। এ সময় বসার ঘরে বুটের শব্দ। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকে পাকিস্তানি হানাদার চার সেনা। তুলে নিয়ে যায় শামসুদ্দীনকে। খানিকটা দূরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয় তাঁকে। দিনটি ছিল একাত্তরের ১৫ এপ্রিল।

শহীদ প্রকৌশলী আবুল কালাম মোহাম্মদ শামসুদ্দীনের জন্ম ১৯২৯ সালের ৯ জানুয়ারি বগুড়া সদর উপজেলার গোকুল গ্রামে। বাবা আবুল ফজল মোহাম্মদ সোলাইমান ছিলেন বগুড়া ইয়াকুবিয়া বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। চার ভাই এক বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন বড়। শৈশব থেকেই চিকিৎসক বা প্রকৌশলী হওয়ার স্বপ্ন ছিল তাঁর। সেভাবেই ধাপে ধাপে তৈরি করেছিলেন নিজেকে।

আবুল কালাম শামসুদ্দীন বগুড়া জিলা স্কুল থেকে ১৯৪৪ সালে মাধ্যমিক ও ১৯৪৬ সালে সরকারি আজিজুল হক কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে ভারতের শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হন। তবে ভারত ভাগের পর ১৯৪৭ সালে ঢাকায় এসে আহছানউল্লা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে প্রথম ব্যাচে ভর্তি হন। পাঠপর্ব শেষ করে ১৯৫২ সালে তিনি চট্টগ্রামের রাঙামাটির কাপ্তাই পানিবিদ্যুৎ প্রকল্পে প্রকৌশলী হিসেবে যোগ দেন। কুমিল্লার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট আকরামউদ্দীনের মেয়ে মাহাবুবা বেগমের সঙ্গে ১৯৫৫ সালে তাঁর বিয়ে হয়। তাঁদের তিন সন্তান চুমকি, হাসান চন্দন ও লাবণি। তাঁর স্ত্রী ও এক মেয়ে মারা গেছেন। ছেলে হাসান চন্দন পেশায় আলোকচিত্রী, ঢাকায় বসবাস করেন। আরেক মেয়ে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী।

চলতি বছর প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের শহীদ বুদ্ধিজীবীর প্রজ্ঞাপনে প্রকৌশলী আবুল কালাম শামসুদ্দীনের নাম রয়েছে। শহীদ শামসুদ্দীন স্মরণে স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে কর্ণফুলী বিদ্যুৎকেন্দ্রে ‘কাপ্তাই শহীদ শামসুদ্দীন বালিকা উচ্চবিদ্যালয়’ এবং পরে শহীদ শামসুদ্দীন স্মৃতি সংসদ স্থাপিত হয়।

বাবার স্মৃতিচারণা করে হাসান চন্দন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর বাবা ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার সমর্থনে তিনি কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কর্মচারীদের নিয়ে মিছিল করেছিলেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী চট্টগ্রাম অঞ্চলে ঢুকে নিরীহ বাঙালি পরিবারের ওপর অত্যাচার শুরু করলে ভয়ে অনেকেই কাপ্তাই পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প ছেড়ে পালাতে শুরু করেন। অনেকে তাঁর বাবাকে পালিয়ে যেতে পরামর্শ দিলেও তিনি যাননি।

একাত্তরের ১৫ এপ্রিল হানাদার সেনারা কাপ্তাই দখল করে। পানিবিদ্যুৎকেন্দ্রের আবাসিক এলাকার বাসা থেকে দুপুরে তারা প্রকৌশলী এ কে সালেহ ও প্রকৌশলী আবুল কালাম শামসুদ্দীনকে গাড়িতে তুলে নেয়। চন্দন বলেন, ‘গাড়ি কিছুদূর এগিয়ে যাওয়ার পর দুটি গুলির আওয়াজ শুনতে পাই আমরা। অজানা শঙ্কায় বাসার সবাই কান্নাকাটি করতে থাকি। কিছুক্ষণ পর প্রকৌশলী সালেহ ফিরে এলেও বাবা আসেননি। জানলাম, বাবাকে ওরা গুলি করে হত্যা করেছে। পরে লাশ ফেরত দিলে কাপ্তাই পানিবিদ্যুৎ প্রকল্পের রাষ্ট্রীয় অতিথিশালাসংলগ্ন টিলার কাছে দাফন করা হয়।’

গ্রন্থনা: আনোয়ার পারভেজ, বগুড়া।