আবদুস সামাদ ছিলেন ডিপ্লোমা প্রকৌশলী। পাকিস্তানি হানাদার সেনারা গণহত্যা শুরু করলে নারায়ণগঞ্জ শহরে তিনি প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নিয়ে শহীদ হন।
নারায়ণগঞ্জ শহরের ইসদাইর এলাকায় নিজেদের বাড়িতে বসবাস করতেন আবদুস সামাদ। স্ত্রী সালমা বেগম (৭০) স্বামীর স্মৃতিচারণা করে প্রথম আলোকে বলেন, ফতুল্লার একটি কোল্ডস্টোরেজের প্রকৌশলী ছিলেন তাঁর স্বামী। স্থানীয় বাসিন্দারা মান্যগণ্য করতেন, সালিস–বিচারে ডাকতেন। পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকায় গণহত্যা শুরুর পর একাত্তরের ২৬ মার্চ সকালে তাঁর বাড়ির সামনে তিন-চার ব্যক্তি ছুটে আসেন পরামর্শ নিতে। তিনি তাঁদের নিয়ে প্রতিরোধযুদ্ধের প্রস্তুতি নেন। বিভিন্ন জায়গা থেকে শত শত কাচের বোতল বাড়িতে এনে পেট্রলবোমা তৈরি করেন। একপর্যায়ে তাঁরা চাষাঢ়া পুলিশ ফাঁড়ি ও কোর্ট থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করেন। আরও অনেকের সঙ্গে মিলে তাঁরাও শহরের বিভিন্ন সড়কে গাছ কেটে, ইটের স্তূপ করে এবং রেললাইন উপড়ে ফেলে যোগাযোগব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করেন।
সালমা বেগম বলেন, ২৭ তারিখ সকালেই তিনি হানাদারদের প্রতিরোধ করতে সম্মুখযুদ্ধে গিয়েছিলেন। কিছুক্ষণ পর তিনি বাড়িতে ফিরে এসে তাঁর কাছে পানি খেতে চান। পানি খেয়ে তিনি সন্তানদের নিয়ে স্ত্রীকে গ্রামের বাড়ি চলে যেতে বলেন। সামাদ বলেছিলেন, ‘এত মানুষকে বিপদে ফেলে আমার পক্ষে পালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তোমরা সন্তানদের নিয়ে চলে যাও। আমি পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ চালিয়ে যাব।’ এই বলে তিনি বাসা থেকে বের হয়ে যান। ‘আমরা ওই দিন এক কাপড়ে সন্তানদের নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যাই। হেঁটে কমলাঘাট হয়ে বিক্রমপুরে বাপের বাড়ি চলে আসি। এরপর তাঁর শহীদ হওয়ার খবর পাই।’ আবদুস সামাদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা একাত্তরের ২৭ মার্চ ইসদাইর এলাকার বাবুর পুকুরপাড়ে হানাদারদের প্রতিরোধের চেষ্টা করেন। তবে হানাদার সেনাদের ভারী অস্ত্রের হামলায় তাঁরা বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারেননি। প্রতিরোধযুদ্ধে আবদুস সামাদ শহীদ হন। তিন দিন পর বাবুর পুকুরপাড়ে সড়ক থেকে তাঁর লাশ উদ্ধার করা হয়।
আগামী প্রকাশনীর শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ গ্রন্থে শহীদ আবদুস সামাদের সংক্ষিপ্ত জীবনী রয়েছে। তাঁর জন্ম ১৯৪১ সালের ১ জুলাই, মুন্সিগঞ্জের টঙ্গিবাড়ী থানার দাইদা গ্রামে। বাবার নাম আবেদ আলী সরকার। তিন ভাইয়ের মধ্যে আবদুস সামাদ সবার ছোট এবং ডিপ্লোমা প্রকৌশলী ছিলেন। আবদুস সামাদ ও সালমা বেগমের তিন সন্তান।
সালমা বেগম জানান, মুক্তিযুদ্ধের পর ইসদাইরে এসে দেখেন, বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ঘরের খুঁটি ছাড়া কিছুই ছিল না। বহু কষ্ট করে তিনি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছেন। বড় ছেলে শাহিন আলম ২০১৭ সালে মারা গেছেন। ছোট ছেলে শাকিল আলম ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। মেয়ে লিপি আক্তারের বিয়ে হয়েছে। তাঁর স্বামী শহীদ আবদুস সামাদের নাম মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের গেজেটে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তাঁরা মাসিক ভাতা পাচ্ছেন। আবদুস সামাদ যেখানে শহীদ হয়েছেন, সেই বাবুর পুকুরপাড় এলাকার ইসদাইর থেকে বিশ্বরোড সংযোগ সড়কটি তাঁর নামে নামকরণ করার জন্য দাবি জানান সালমা বেগম।
নারায়ণগঞ্জের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রফিউর রাব্বি এবং সদর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার জুলহাস উদ্দিন প্রথম আলোকে জানান, একাত্তরের ২৭ মার্চ প্রতিরোধযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা প্রায় ২৪ ঘণ্টা হানাদার সেনাদের আটকে রাখেন। এতে সাধারণ মানুষ শহর ছেড়ে নিরাপদে চলে যেতে পারে। ওই যুদ্ধে আবদুস সামাদসহ প্রায় ৪০ জন শহীদ হন। পরিবার থেকে শহীদ আবদুস সামাদের নামে যে সড়কের নামকরণ করার দাবি করা হয়েছে, তা যথার্থ।
গ্রন্থনা: মজিবুল হক, নারায়ণগঞ্জ