বিজ্ঞাপন
default-image

প্রতিভাবান তরুণ ছিলেন মেহেরপুরের আবদুল হামিদ। যেমন ভালো অভিনয় করতেন, তেমনি সুনাম কুড়িয়ে ছিলেন খেলাধুলায়।

তবে তাঁর প্রতিভা বিকাশের সুযোগ দেয়নি রাজাকাররা। মুক্তিযুদ্ধের সময় আজকের এই দিন ৩ ডিসেম্বরে মায়ের সামনে থেকে তাঁকে তুলে নিয়ে গিয়ে নির্মম নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছিল।
মেহেরপুর শহরে তখন থমথমে পরিবেশ। মুক্তিযোদ্ধা ও পাকিস্তানি হানাদারদের মধ্যে যুদ্ধ চলছে।

মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে শহরের দেয়ালে দেয়ালে তখন পোস্টার আর গোপনে লিফলেট বিলি করা হচ্ছিল। এতে নেতৃত্ব দিতেন তরুণ নাট্যাভিনেতা ও খেলোয়াড় আবদুল হামিদ। সেদিন তিনি বাড়িতে দুপুরের খাবারে বসেছেন।

মা থালায় খাবার তুলে দিচ্ছেন। ঠিক সে সময় স্থানীয় শরীফ বিহারির নেতৃত্বে একদল রাজাকার ও তাদের প্রভু পাকিস্তানি হানাদার সেনারা শহরের গভর্নমেন্ট হাইস্কুল পাড়ায় তাঁদের বাড়িতে হানা দেয়।

মায়ের সামনেই খাবারের থালা থেকে হামিদকে তুলে পিছমোড়া করে বেঁধে ট্রাকে করে নিয়ে যায় সরকারি কলেজে সেনাক্যাম্পে। প্রচণ্ড নির্যাতন করে হত্যা করে ৩ ডিসেম্বর কলেজ প্রাঙ্গণে গণকবরে মাটিচাপা দেওয়া হয় তাঁর লাশ।

পরে স্বজনেরা লাশের সন্ধান পেয়ে কাজী নজরুল শিক্ষা মঞ্জিল প্রাঙ্গণের এক কোণে সমাহিত করেন।
মেহেরপুরের মুক্তিযোদ্ধারা ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে হানাদার বাহিনীর সঙ্গে তুমুল যুদ্ধ করছিলেন। এই মুক্তিযোদ্ধাদের সেই সময় তথ্য ও খাবার সরবরাহ করাসহ বিভিন্নভাবে সহায়তা করতেন স্থানীয় তরুণ ছাত্র-যুবকেরা।

আবদুল হামিদ ছিলেন এই দলের নেতৃস্থানীয়। স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গড়ে তোলার জন্য বন্ধু ও সমমনা সাংস্কৃতিক কর্মীদের নিয়ে তিনি একটি দল গঠন করেছিলেন।

তিনি রাতের আঁধারে স্কুলের প্রাচীরে, বাড়ির দেয়ালে, দোকানে, চায়ের স্টলে পোস্টার সেঁটে দিতেন স্বাধীনতার পক্ষে।

লিখতেন বিপ্লবী কবিতা ও গানের লাইন। এসব পোস্টারের স্লোগান ও কবিতা তখন মানুষের মুখে মুখে ফিরত। এ কারণে স্থানীয় অবাঙালি ও রাজাকারদের চক্ষুশুলে পরিণত হন তিনি।
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে তথ্য চেয়ে প্রথম আলোতে বিজ্ঞাপন ছাপা হলে মেহেরপুর সরকারি কলেজের সহযোগী অধ্যাপক আবদুল্লাহ আল-আমিন শহীদ আবদুল হামিদের ছবি ও তাঁর জীবনকর্ম নিয়ে তথ্যসমৃদ্ধ একটি লেখা পাঠান। সেই সূত্র ধরে অনুসন্ধান করা হয়।
অদম্য সাহসী, নাট্যাভিনেতা, সংস্কৃতিসেবী ও ক্রীড়া সংগঠক শহীদ আবদুল হামিদের জন্ম ১৯৫৪ সালে মেহেরপুর শহরের গভর্নমেন্ট হাইস্কুলসংলগ্ন এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। বাবা আবদুর রশীদ ব্যবসায়ী, মা হাদিসা বেগম গৃহিণী।

তিনি ছিলেন ছয় ভাই ও এক বোনের মধ্যে সবার বড়। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত কাজী সাজ্জাদ আলী জহিরের মুক্তিসংগ্রামে মেহেরপুর এবং এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত ড. হারুণ আর রশিদ সম্পাদিত বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ বইয়ে আবদুল্লাহ আল আমিনের নিবন্ধে শহীদ হামিদের বীরোচিত আত্মত্যাগের কথা উল্লেখ রয়েছে।

আগামী প্রকাশনীর রফিকুর রশীদের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ: মেহেরপুর জেলা, অন্বেষা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত তোজাম্মেল আযমের মুজিবনগর: যুদ্ধজয়ের উপাখ্যান বইতেও শহীদ নাট্যাভিনেতা, সংস্কৃতিসেবী ও ক্রীড়া সংগঠক আবদুল হামিদের অবদান ও আত্মত্যাগের বর্ণনা রয়েছে। শহীদ হামিদের স্মৃতি রক্ষার্থে মেহেরপুর শহরের একটি রাস্তার নামকরণ করা হয় ‘শহীদ হামিদ সড়ক’।

১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শহীদ হামিদের পরিবারকে সমবেদনা জানিয়ে চিঠি পাঠিয়েছিলেন।
গ্রন্থনা: আবু সাঈদ, মেহেরপুর