ওষুধ কিনতে গ্রাম থেকে গোপালগঞ্জ শহরে গিয়েছিলেন চিকিৎসক আবদুল মান্নান মোল্লা। মুসলিম লীগ আর শান্তি কমিটির লোকজন লঞ্চঘাট থেকে তাঁকে ধরে তুলে দেয় পাকিস্তানি হানাদার সেনাদের হাতে। টানা তিন দিন অমানুষিক নির্যাতন করে হত্যা করা হয় স্বাধীনতাকামী এই চিকিৎসককে।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর তাঁর জন্মস্থান গোপালগঞ্জে স্বাধীনতার পক্ষে ব্যাপক গণজোয়ার সৃষ্টি হয়। চিকিৎসক আবদুল মান্নান তাঁর পেশাগত কাজের পাশাপাশি তরুণসমাজকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য সংগঠিত করা শুরু করেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দিতেন।
শহীদ আবদুল মান্নানের জন্ম গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার শুকতাইল গ্রামে। তাঁর বাবা আবদুল গনি মোল্লা, মা রয়েচা বেগম। তিনি ছিলেন আট ভাইবোনের মধ্যে তৃতীয়। স্থানীয় গোপীনাথপুর উচ্চবিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ থেকে তিনি এলএমএফ ডিগ্রি নিয়ে টাঙ্গাইলের কুমুদিনী হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে পেশগত জীবন শুরু করেন। এরপর তিনি নিজ এলাকায় ফিরে এসে গোপীনাথপুর হাসপাতালে যুক্ত হন। ১৯৪৯ সালে তিনি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগে যোগ দেন এবং শুকতাইলে দলের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এ সময় থেকে তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন এবং চাকরি ছেড়ে স্বাধীনভাবে রোগী দেখতেন। গ্রামের দরিদ্র ও সাধারণ মানুষদের বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা দিতেন। মুসলিম লীগ ও শান্তি কমিটির নেতা পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় বাণিজ্যমন্ত্রী ওয়াহিদুজ্জামান তাঁকে মুসলিম লীগে যোগ দিতে চাপ দিয়েছিলেন। আবদুল মান্নান রাজি না হওয়ায় রাজাকাররা তাঁর ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।
আবদুল মান্নানের ছেলে জাহিদ মোল্লা প্রথম আলোকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তাঁর বাবা আহত মুক্তিযোদ্ধা ও গ্রামের অসহায় লোকদের চিকিৎসা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। একটা পর্যায়ে তাঁর কাছে থাকা ওষুধ শেষ হয়ে যায়। ১৩ জুন তিনি ওষুধ আনার জন্য শুকতাইল গ্রাম থেকে যান গোপালগঞ্জে। লঞ্চঘাটে পৌঁছালে মুসলিম লীগ ও শান্তি কমিটির লোকজন তাঁকে আটক করে সিও অফিসে থাকা (বর্তমানে উপজেলা কার্যালয়) পাকিস্তানি সেনা ক্যাপ্টেন ফয়েজের কাছে তুলে দিয়ে বলে, ‘আপনি যাকে খুঁজছিলেন, এই সেই মান্নান ডাক্তার।’ সেখানে ১৩ থেকে ১৬ জুন প্রচণ্ড নির্যাতন করে তাঁকে হত্যা করা হয়। সিও অফিসের পাশের বধভূমিতে তাঁর মরদেহ ফেলে রাখা হয়েছিল।
জাহিদ মোল্লা গোপালগঞ্জ পৌরসভায় চাকরি করেন। তাঁর তিন বোন গৃহবধূ। মা হাসিনা বেগম ২০১৭ সালে মারা গেছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ৬ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর কাছে সমবেদনা জানিয়ে চিঠি ও দুই হাজার টাকা পাঠান। ঐতিহ্য থেকে প্রকাশিত তপন বাগচীর মুক্তিযুদ্ধে গোপালগঞ্জ বইয়ে আবদুল মান্নান মোল্লার জীবনী রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের ২০০৫ সালের গেজেটেও বেসামরিক শহীদদের তালিকার ৩৯৭ নম্বরে তাঁর নাম অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
গ্রন্থনা: নুতন শেখ, গোপালগঞ্জ