শিক্ষক মুক্তিযোদ্ধা, কিন্তু তাঁর ছাত্র রাজাকার। মুক্তিযোদ্ধারা তখন বীরবিক্রমে লড়ে যাচ্ছেন হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে। শিক্ষক তরুণদের উদ্বুদ্ধ করতেন যুদ্ধে যেতে। একদিন ওই ছাত্র হানাদারদের নিয়ে এসে ঘিরে ফেলল শিক্ষকের বাড়ি। জ্বালিয়ে দিল সবকিছু। হত্যা করল শিক্ষক, তাঁর বাবা-ভাইসহ পরিবারের ২০ জনকে। ঘটনাটি ঘটেছিল কিশোরগঞ্জ জেলার মিঠামইন উপজেলার ঘাগড়া ইউনিয়নের ধোবাজোড়া গ্রামে, একাত্তরের ১ সেপ্টেম্বর। এই শিক্ষক হলেন তৎকালীন মিঠামইন জুনিয়র হাইস্কুলের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক আবদুল মান্নান ভূঞা।
শহীদ আবদুল মান্নান ভূঞা ছিলেন মিঠামইন এলাকার জনপ্রিয় শিক্ষক। ‘মান্নান স্যার’ নামে খ্যাত ছিলেন তিনি। বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদসহ অনেক বিখ্যাত ছাত্র রয়েছে তাঁর।
মিঠামইনের ধোবাজোড়া গ্রামে ১৯২৬ সালে আবদুল মান্নান ভূঞার জন্ম। তাঁর বাবার নাম আবদুল আজিজ ভূঞা। তিনিও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। আবদুল মান্নান ১৯৪৭ সালে অষ্টগ্রাম উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। পরে জেলা শহরের গুরুদয়াল সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি ও বিএ পাস করেন। পাশাপাশি ময়মনসিংহ থেকে বিটি (ব্যাচেলর টিচিং) ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর পরিচিতি রয়েছে বাংলা একাডেমির শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ গ্রন্থে।
আবদুল মান্নানের ছেলে বি এম সেলিমুজ্জামান বলেন, নরপশু পাকিস্তানি সেনারা গণহত্যা শুরু করলে তাঁর বাবা তাঁর অনেক ছাত্র ও এলাকার যুবকদের সংগঠিত করে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করে তোলেন। তাঁদের অনেক বড় যৌথ পরিবার। পরিবারের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। চাচা রুকনুজ্জামান ভূঞাও যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তাঁরা এলাকার রাজাকারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। এ কারণে বাবার একসময়ের ছাত্র রাজাকার কমান্ডার কোরফান তাঁদের পরিবারের প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।
সেদিনের মর্মান্তিক ঘটনার স্মৃতিচারণা করে সেলিমুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন। তখন তাঁর বয়স ছিল ১৩ বছর। বাবার প্রতিষ্ঠিত স্কুলে তিনি অষ্টম শ্রেণিতে পড়তেন। ১ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে নয়টার দিকে রাজাকার কমান্ডার কোরফানসহ পাকিস্তানি বাহিনী তাঁদের বাড়ি ঘেরাও করে। তিনি সাঁতরে বাড়ির পাশের খাল পার হয়ে জীবন বাঁচান। খালের অপর পাড় থেকে বাড়িতে লুটতরাজ ও আগুন দেওয়ার দৃশ্য দেখা যাচ্ছিল। গুলির শব্দ শুনতে পাচ্ছিলেন। ঘাতকেরা চলে গেলে বাড়িতে এসে দেখতে পান, তাঁর দাদা আবদুল আজিজ ভূঞাসহ চারজনকে গুলি করে হত্যা করে লাশ উঠানে ফেলে রাখা হয়েছে। তাঁর বাবা আবদুল মান্নান ও চাচা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএসসির ছাত্র রুকনুজ্জামানসহ পরিবারের ১৬ জনকে ঘাতকেরা ধরে নিয়ে গেছে। বিজয় অর্জনের পর ডিসেম্বর মাসেই স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকার কমান্ডার কোরফানকে আটক করেন। সে স্বীকার করে যে আবদুল মান্নান ভূঞাসহ পরিবারের ১৬ জনকে তুলে নিয়ে পাকিস্তানি সেনারা গুলি করে হত্যা করেছে। তারা লাশ বস্তায় ভরে ইটনার হাওরের পানিতে ভাসিয়ে দিয়েছিল। এই রাজাকার কমান্ডার মিঠামইন এলাকার প্রায় দুই হাজার নিরপরাধ মানুষকে হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল।
সেলিমুজ্জামান জানান, তাঁর মা আক্তার বেগমের বয়স নব্বইয়ের কাছাকাছি। তাঁরা ৬ ভাইবোন এখনো পরিবারের ২০ জন সদস্যের মৃত্যুর শোক বয়ে চলেছেন।
গ্রন্থনা: তাফসিলুল আজিজ, প্রতিনিধি, কিশোরগঞ্জ