বিজ্ঞাপন
default-image

‘মা, আমি একজন ডাক্তার। ইপিআরের দেড় শ আহত সদস্য হাসপাতালে। তাঁদের রেখে কীভাবে যাব? কেউ আমার ক্ষতি করবে না, ডাক্তারদের কোনো শত্রু থাকে না। আমি আহত ব্যক্তিদের ওষুধপত্র দিয়ে অন্যত্র রেখে তোমাদের কাছে চলে আসব।’

একাত্তরের ৯ এপ্রিল ভারত সীমান্তবর্তী রামচন্দ্রপুর গ্রামে পরিবারকে নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠানোর সময় এই ছিল মায়ের সঙ্গে চিকিৎসক আবদুল জব্বারের শেষ কথা। কিন্তু তিনি জানতেন না পাকিস্তানি হানাদার সেনাদের কাছে চিকিৎসকেরাও নিরাপদ নন। দিনাজপুর সদর হাসপাতালের অস্ত্রোপচার কক্ষ থেকে ডেকে নিয়ে গলায় রশি পেঁচিয়ে হানাদার সেনারা তাঁকে হত্যা করেছিল সেদিন। শহীদ আবদুল জব্বারের বড় ছেলে হারুন অর রশিদ গত রোববার প্রথম আলোর কাছে বাবার স্মৃতিচারণা করে এসব কথা বলেন।

শহীদ আবদুল জব্বার মুক্তিযুদ্ধের সময় দিনাজপুর সদর হাসপাতালের চিকিৎসক ছিলেন। একই সঙ্গে তিনি জেলার ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জনের দায়িত্বও পালন করছিলেন। একাত্তরে মার্চের শেষে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস এবং দিনাজপুরের কুঠিবাড়ির সেক্টর হেডকোয়ার্টারে কিছুসংখ্যক বাঙালি সৈনিক মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নেন। হানাদার বাহিনীর সঙ্গে এই বাঙালি ইপিআর, পুলিশ, আনসারদের প্রচণ্ড গোলাগুলি হয়। অনেকেই আহত হয়ে ভর্তি হন সদর হাসপাতালে। আবদুল জব্বার আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা দিয়ে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে রাখতেন।

১৩ এপ্রিল রংপুর ও সৈয়দপুর সেনানিবাস থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তিন দিক থেকে দিনাজপুর শহরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। তাদের গুলি, কামান আর মর্টারের শব্দে শহর ফাঁকা হয়ে যায়। ২৯ এপ্রিল সন্ধ্যায় হানাদার সেনারা সদর হাসপাতালে প্রবেশ করে। আবদুল জব্বার সবে একজনের অস্ত্রোপচার শেষ করেছেন। তাঁর সঙ্গে এক অবাঙালি চিকিৎসকও ছিলেন। এক হানাদার সেনা আবদুল জব্বারকে জানান, তিনি জরুরি রোগী নিয়ে এসেছেন। ঘাতক সেনারা আবদুল জব্বারকে তাঁর কক্ষে এনে গলায় রশি পেঁচিয়ে হত্যা করে।

স্বাধীনতার পরে ওই অবাঙালি চিকিৎসক শহীদ জব্বারের জামাতা মুক্তিযোদ্ধা লে. কর্নেল নুরুন্নবী খানের (বীর বিক্রম) কাছে হত্যা ও নির্যাতনের বর্ণনা দেন। হানাদার সেনারা সেদিন হাসপাতালে থাকা আহত মুক্তিযোদ্ধাদেরও হত্যা করে। আবদুল জব্বার ও অন্য দুজনের লাশ পুঁতে রাখে। পরে আবদুল জব্বারের চশমা, পোশাক দেখতে পায় পরিবার।

শহীদ জব্বারের গ্রামের বাড়ি নারায়ণগঞ্জ জেলার ফতুল্লা থানার কাশিপুর গ্রামে। আহমেদ আলী সরদার ও আনজুমান আরা বেগমের একমাত্র সন্তান তিনি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন তিনি। বর্তমানে তাঁর সাত সন্তান দিনাজপুর ও ঢাকায় বসবাস করছেন।

দিনাজপুর সরকারি সিটি কলেজের অধ্যক্ষ মোজাম্মেল বিশ্বাস ও জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক পারভেজ সোহেল কিছু তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন। ১৯৯২ সালে দিনাজপুর থেকে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে গবেষণা গ্রন্থ প্রকৌশলী ইফতেখার কাজল সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসকদের স্মৃতিকথা রক্তঋণ গ্রন্থে আবদুল জব্বারের নাম রয়েছে। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন থেকে তাঁকে মরণোত্তর ‘দিনাজপুর স্বর্ণপদক’ (২০০৩) প্রদান করা হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থাপিত শহীদ চিকিৎসকদের নামফলকে তাঁর নাম রয়েছে। এ ছাড়া সম্প্রতি তাঁর সর্বশেষ কর্মস্থল দিনাজপুর সদর হাসপাতালের একটি মিলনায়তনের নামকরণ হয়েছে তাঁর নামে।

গ্রন্থনা: রাজিউল ইসলাম, দিনাজপুর