লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার শিক্ষক আবদুল গফুরকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য বাড়ি থেকে তুলে থানায় নিয়েছিল পাকিস্তানি হানাদার সেনারা। স্থানীয় রাজাকাররা বাড়িটি চিনিয়ে দিয়েছিল। তিনি মাগরিবের নামাজ শেষে মোনাজাত করছিলেন। সেই অবস্থাতেই বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে তাঁকে হত্যা করে ঘাতক সেনারা।
শহীদ শিক্ষক আবদুল গফুরের বড় ছেলে কালীগঞ্জের মুনসীর বাজারের মুদিদোকানের মালিক শামসুল আলম তাঁর বাবাকে নির্মমভাবে হত্যার বর্ণনা দিয়েছেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, একাত্তরে তিনি ছিলেন চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। সেদিন ছিল ১৮ এপ্রিল। ঘটনাটি তাঁর স্পষ্ট মনে আছে। বিকেলে একদল পাকিস্তানি সেনা স্থানীয় রাজাকারদের সঙ্গে এসে তাঁদের বাড়ি ঘিরে ফেলে। জিজ্ঞাসাবাদের কথা বলে তাঁর বাবাকে থানায় যেতে বলা হয়। তাঁর মা অনেক কান্নাকাটি করছিলেন বাবাকে তুলে না নেওয়ার জন্য। বাবা না গেলে বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ার হুমকি দিতে থাকে রাজাকাররা। তখন সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে বাবা ওদের সঙ্গে বাড়ি থেকে বের হয়ে যান।
পরে তাঁরা খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, কালীগঞ্জ থানায় তাঁকে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে তথ্য দিতে জোরজবরদস্তি করা হয়। তখন মাগরিবের নামাজের সময় হলে তিনি নামাজ আদায় করতে বসেন। নামাজ শেষে যখন তিনি মোনাজাত করছিলেন তখন ঘাতকেরা পেছন থেকে তাঁকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। গভীর রাতে রাজাকাররা থানার পাশে রেললাইনের ধারে গর্ত করে লাশ মাটিচাপা দেয়।
শহীদ আবদুল গফুর ছিলেন কালীগঞ্জ উপজেলার মদনপুর বৈরাতি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। একাত্তরের উত্তাল দিনগুলোতে তিনি ছিলেন স্বাধীনতার পক্ষে সোচ্চার। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ রেডিওতে শোনার পর আর বিদ্যালয়ে দায়িত্ব পালন করতে যাননি। হানাদার বাহিনী গণহত্যা শুরু করলে তিনি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এপ্রিলের শুরুতেই তিনি প্রশিক্ষণ নিতে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার যান। সেখানে সংক্ষিপ্ত সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়ে দ্রুতই বাড়িতে ফিরে আসেন। গোপনে তিনি এলাকার যুবকদের সংগঠিত করতে থাকেন। রাজাকাররা বিষয়টি জানতে পেরে পাকিস্তানি সেনাদের কাছে তাঁকে ধরিয়ে দেয়।
আবদুল গফুরের জন্ম ১৯১৯ সালের ১৫ জুলাই কালীগঞ্জের তুষভান্ডার ইউনিয়নের কাশীরাম গ্রামের দরিদ্র কৃষক পরিবারে। আর্থিক সংকটের কারণে ঠিক সময়ে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দিতে পারেননি। পরে ১৯৫৮ সালে রংপুর জিলা স্কুল থেকে প্রাইভেটে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হন। কালীগঞ্জের মদনপুর বৈরাতি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তিনি যোগ দেন সহকারী শিক্ষক হিসেবে। ১৯৬৯ সালে এই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে পদোন্নতি পান। আমৃত্যু প্রধান শিক্ষক পদেই ছিলেন।
মৃত্যুর সময় আবদুল গফুর স্ত্রী সালেহা বেগমসহ চার ছেলে ও ৪০ দিন বয়সের এক মেয়েকে রেখে যান। তাঁর স্ত্রী ২০১৭ সালে ইন্তেকাল করেন।
শহীদ আবদুল গফুরের স্মৃতি রক্ষার্থে ১৯৭২ সালে কালীগঞ্জের পশ্চিম কাশীরাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি তাঁর নামে নামকরণ হয়। কালীগঞ্জ উপজেলা কেন্দ্রীয় স্মৃতিসৌধে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকায় আবদুল গফুরের নাম ৩ নম্বরে রয়েছে। বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ লালমনিরহাট জেলা ইউনিট কমান্ডের সাবেক কমান্ডার মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ স্বাক্ষরিত মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সমাধিস্থল সংরক্ষণ ও উন্নয়নের তালিকায়ও তাঁর নাম রয়েছে।
গ্রন্থনা: আবদুর রব, লালমনিরহাট