বিজ্ঞাপন
default-image

মুক্তিযুদ্ধের সময় বরিশাল ব্রজমোহন (বিএম) স্কুলের ইংরেজির শিক্ষক ছিলেন অতুল চন্দ্র কর্মকার। পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন শহরের নতুন বাজার এলাকায়। রাজনীতিসচেতন ও সংস্কৃতিমনা মানুষ ছিলেন। দেশের প্রতি ছিল গভীর ভালোবাসা। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পর সারা দেশ উত্তাল হয়ে উঠলে তিনিও মুক্তিযুদ্ধের জন্য অনুপ্রাণিত হন। পাকিস্তানি হানাদার সেনারা গণহত্যা শুরু করলে পরিবারের কাউকে কিছু না জানিয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধে চলে যান।

অতুল চন্দ্রের স্ত্রী কনকলতা কর্মকার সপ্তাহখানেক পর জানতে পারেন, তাঁর স্বামী ঝালকাঠির বাউকাঠিসংলগ্ন আটঘর কুড়িয়ানা এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। এখানেই ২৪ মে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে তিনি শহীদ হন।

প্রথম আলোতে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে তথ্য চেয়ে বিজ্ঞাপন ছাপা হলে শহীদ অতুল চন্দ্র কর্মকারের একমাত্র ছেলে বাসুদেব কর্মকার তাঁর বাবার সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য ও ছবি পাঠান। তিনি জানান, বরিশাল শহরের কাশিপুর এলাকায় ১৯২৩ সালে অতুল চন্দ্র কর্মকারের জন্ম। তাঁর বাবা উমাচরণ কর্মকার, মা বনলতা কর্মকার। তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। ১৯৫২ সালে তিনি বিএম কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে সেই বছরই বিএম স্কুলে ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন।

বাসুদেব প্রথম আলোকে বলেন, বরিশালে হানাদার সেনাদের নিপীড়ন বাড়তে থাকলে তাঁর মা, বড় বোন ছবি রানী কর্মকার ও তিনি ঝালকাঠির নবগ্রাম এলাকার রামচন্দ্রপুর গ্রামে রশিদ মাঝি নামের এক ব্যক্তির বাড়িতে আশ্রয় নেন। এখানে থাকার সময় ২৪ মে সকালে খবর পান, ঝলকাঠির পেয়ারা বাগানে যুদ্ধ চলছে। মুক্তিযোদ্ধাসহ অনেক বাঙালিকে পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করেছে। সন্ধ্যায় যুদ্ধ শেষে সেনারা ফিরে গেলে মা কনকলতা তাঁকে নিয়ে পেয়ারা বাগান এলাকায় যান। সেখানে তাঁরা নদীর পাড়ে ও চরে অনেক মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখেন। সেখানে অতুল চন্দ্রের লাশ খুঁজতে খুঁজতে রাত হয়ে যায়। একপর্যায়ে তাঁরা গুলিতে ক্ষতবিক্ষত তাঁর লাশ খুঁজে পান। ধর্মীয় রীতিতে সৎকার করার মতো অবস্থা ছিল না। পাটকাঠি জ্বালিয়ে কোনোমতে মুখাগ্নি করা হয়। তাঁর মায়ের আকুতিকে আশপাশের কিছু লোকের সহায়তায় সেখানেই মরদেহ মাটিচাপা দেওয়া হয়। এরপর সেখান থেকে ফিরে তাঁরা কলকাতায় শরণার্থীশিবিরে আশ্রয় নেন। দেশ স্বাধীন হলে বরিশাল ফিরে আসেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর মায়ের কাছে সমবেদনা জানিয়ে চিঠি পাঠিয়েছিলেন, সঙ্গে দুই হাজার টাকার অনুদান।

বাসুদেব জানান, তাঁর মা ২০১৪ সালে পরলোক গমন করেছেন। বড় বোন ছবি রানী গৃহবধূ। তিনি বরিশাল শহরের শ্রীমৎ স্বামী প্রজ্ঞাননানন্দ
সরস্বতী ট্রাস্টের সাধারণ সম্পাদক। তাঁরা শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে তাঁদের বাবার সরকারি স্বীকৃতির জন্য ৫০ বছর ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। ২০১৩ সালে অনলাইনে আবেদনও করেন। ২০১৭ সালে বরিশাল জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ কাউন্সিলের (জামুকা) প্রতিনিধির উপস্থিতিতে বাসুদেব বঙ্গবন্ধুর চিঠিসহ বিভিন্ন তথ্যপ্রমাণ দাখিল করে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। যাচাই–বাছাই করে তাঁর বাবার নাম ‘ক’ তালিকায় ৫৯ নম্বরে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু সরকারি গেজেটে এখনো তাঁর নাম ওঠেনি। এই আক্ষেপ নিয়ে তাঁর মা মারা গেছেন। তাঁরা দুই ভাইবোন মনোবেদনায় রয়েছেন।

গ্রন্থনা: এম জসীম উদ্দীন, বরিশাল