বিজ্ঞাপন
default-image

বাড়ির দীর্ঘদিনের কর্মীরাই রাজাকারদের যোগসাজশে পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে তুলে দিয়েছিল স্কুলশিক্ষক হীরেন্দ্র চন্দ্র মজুমদার ও তাঁর দুই ভাইকে। হীরেন্দ্রদের পরিবার ছিল অবস্থাপন্ন। সম্পদ হাতিয়ে নেওয়ার লোভে তারা এই ঘৃণ্য কাজ করেছিল।

ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার খামারগাঁও গ্রামের ‘সরকার বাড়ি’র শহীদ তিন ভাইয়ের মধ্যে বড় খগেন্দ্র জীবন মজুমদার ছিলেন পল্লিচিকিৎসক। মেজ ভাই হীরেন্দ্র চন্দ্র মজুমদার স্কুলশিক্ষক ও ছোট ভাই ভূপেন্দ্র চন্দ্র মজুমদার ব্যবসায়ী। তাঁরা ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। মুক্তিযোদ্ধাদের অর্থ, খাবার দেওয়াসহ নানাভাবে সহায়তা করেছেন। এ কারণে এলাকার রাজাকাররা তাঁদের ওপর ক্ষিপ্ত ছিল।

হীরেন্দ্র চন্দ্রের ছেলে নান্দাইলের বাঁশহাটি উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রবাল কান্তি মজুমদার তাঁর পরিবারের ওপর হত্যা-নির্যাতনের ঘটনার বর্ণনা সম্পর্কে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন। তাঁর বাবার জন্ম ১৯২২ সালে। তিনি ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে গ্রামেই উত্তর বানাইর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে নান্দাইলের অবস্থা সংকটজনক হয়ে ওঠে। বাড়ির নারী ও শিশুদের তিনি মুশুলী গ্রামে শ্বশুরবাড়িতে রেখে আসেন। বাড়ির পুরোনো গোমস্তা তারা মিয়া ও আবদুর রব হীরেন্দ্র ও তাঁর ভাইদের নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়েছিল। কিন্তু গোমস্তারা গোপনে যোগাযোগ রাখছিল বারুইগ্রাম মাদ্রাসায় আস্তানা গেড়ে বসা রাজাকার–আলবদরদের সঙ্গে। কিশোরগঞ্জ মহকুমা শহরে ছিল হানাদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাম্প। রাজাকারের দল তাদের মদদে নান্দাইলে ব্যাপক লুটতরাজ, আগুন লাগানো, নারী নির্যাতন, পুরুষদের ধরে নিয়ে মুক্তিপণ আদায় করে ত্রাস সৃষ্টি করেছিল।

প্রবাল কান্তি জানান, একাত্তরের ২৬ নভেম্বর তাঁদের দুই গোমস্তা এই রাজাকারদের নিয়ে এসে বাড়ি ঘেরাও করে। লুটতরাজ চালিয়ে হীরেন্দ্র চন্দ্র মজুমদার, তাঁর দুই ভাই খগেন্দ্র জীবন মজুমদার ও ভূপেন্দ্র চন্দ্র মজুমদারকে পিঠমোড়া করে বেঁধে বারুইগ্রাম মাদ্রাসায় তাদের ঘাঁটিতে নিয়ে যায়। এরপর তারা মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ দাবি করে খবর পাঠায়। আত্মীয়স্বজন নানাভাবে ছয় হাজার টাকা জোগাড় করে রাজাকারদের ঘাঁটিতে পাঠান। টাকা নেওয়ার পরও তারা তিন ভাই হীরেন্দ্র, খগেন্দ্র, ভূপেন্দ্রকে মুক্তি না দিয়ে কিশোরগঞ্জে হানাদার পাকিস্তানি সেনাদের হাতে তুলে দেয়। এরপর আর তাঁদের কোনো খবর পাওয়া যায়নি।

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই তিন ভাইয়ের স্ত্রীদের কাছে আলাদা আলাদা চিঠি পাঠিয়ে সহানুভূতি প্রকাশ করেন। চিঠির সঙ্গে তাঁদের জন্য দুই হাজার টাকা করে তিনটি চেক পাঠানো হয়েছিল। প্রবাল কান্তি সেই চিঠি দেখালেন। তিনি জানান, ১৯৭২ সালে তাঁর বড় কাকা খগেন্দ্র জীবন মজুমদারের স্ত্রী বিদ্যুৎ প্রভা মজুমদার বাদী হয়ে দুই গোমস্তাসহ ১৫ জন চিহ্নিত রাজাকারের বিরুদ্ধে হত্যা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের অভিযোগে আদালতে মামলা করেন। বিচার শেষে ছয়জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। সাজাভোগের পর তারা এখন মুক্ত। এদের একজন আবদুর রশিদ বেঁচে আছে।

প্রবাল কান্তির আক্ষেপ, শহীদ হিসেবে বঙ্গবন্ধু স্বীকৃতি দিয়ে পত্র দিলেও পরিবারের তিন শহীদের নাম মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তালিকায় ওঠেনি।

নান্দাইল উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার মো. মাজহারুল হক ফকির বলেন, পরিবারটি এলাকায় ‘শহীদ পরিবার’ হিসেবে সর্বজনস্বীকৃত। বিভিন্ন সময় জাতীয় পত্রপত্রিকায় তাঁদের আত্মত্যাগ নিয়ে লেখালেখি হয়েছে। পরিবারের সদস্যরা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে স্বীকৃতির জন্য আবেদন করেছেন। তবু শহীদের তালিকায় তাঁদের নাম না থাকা দুঃখজনক।

গ্রন্থনা: রমেশ কুমার, প্রতিনিধি, নান্দাইল, ময়মনসিংহ।