বিজ্ঞাপন
default-image

রামকৃষ্ণ অধিকারী ছিলেন রংপুর কারমাইকেল কলেজের বাংলার অধ্যাপক। তবে তিনি শুধু অধ্যাপনাই করতেন না, লেখক ও গবেষক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতেও সচেষ্ট ছিলেন। কিন্তু সেই সময় পেলেন না। হানাদার পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে।

শহীদ রামকৃষ্ণ অধিকারীর জন্ম ১৯৪৪ সালের ১০ জানুয়ারি বরিশালের বাবুগঞ্জ থানার সুগন্ধা নদীর পাশে বাবুগঞ্জ বন্দর এলাকায়। বাবা রাইচরণ অধিকারী ছিলেন বর্গাচাষি। মা সরলা দেবী। তাঁরা দুই ভাই। রামকৃষ্ণের জন্মের ৯ মাসের মধ্যে তাঁর মা মারা যান। এরপর বউদি বকুল বালা দেবী তাঁকে লালন-পালন করেন।

বাবুগঞ্জ উচ্চবিদ্যালয় থেকে ১৯৬১ সালে মাধ্যমিক ও বরিশাল ব্রজমোহন কলেজ থেকে ১৯৬৩ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে রামকৃষ্ণ অধিকারী ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। সেখান থেকে ১৯৬৭ সালে সম্মানসহ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৮ সালে কারমাইকেল কলেজে বাংলা বিভাগে শিক্ষকতায় যোগ দেন।

সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি তাঁর ছিল বিশেষ অনুরাগ। ছিলেন রাজনীতিসচেতন। সাংগঠনিক ও নেতৃত্বের গুণাবলি ছিল তাঁর মধ্যে। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি জনমত গড়ে তুলতে কাজ করছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তাঁর বাবুগঞ্জের বাড়িতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা লুটতরাজ করে আগুন লাগিয়ে দেয়। বাংলা একাডেমির শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ ও আগামী প্রকাশনীর শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থে অধ্যাপক রামকৃষ্ণ অধিকারীর জীবনী রয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধে কারমাইকেল কলেজের শিক্ষকদের হত্যা নিয়ে গবেষণা করেছেন এই কলেজের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মতিয়ার রহমান। কারমাইকেল কলেজ থেকে প্রকাশিত প্রদীপ্ত সাক্ষর নামের স্মরণিকায় শহীদ অধ্যাপক রামকৃষ্ণ অধিকারীকে নিয়ে মতিয়ার রহমানের লেখা থেকে এসব তথ্য পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন, একাত্তরের মার্চেই বেশির ভাগ অধ্যাপক ও কর্মচারী ক্যাম্পাস ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান। রামকৃষ্ণ অধিকারীও ক্যাম্পাস ছেড়ে গাইবান্ধায় গিয়ে তাঁর এক সহকর্মীর বাড়িতে আশ্রয় নেন। গাইবান্ধা থেকে ২৯ এপ্রিল তিনি আবার কারমাইকেল কলেজের উদ্দেশে রওনা হন। পরদিন কলেজ ক্যাম্পাসে পৌঁছান।

মতিয়ার রহমান প্রথম আলোকে বলেছেন, ঘটনাটি ঘটে একাত্তরের ৩০ এপ্রিল। রামকৃষ্ণ অধিকারী ছিলেন অবিবাহিত। তিনি থাকতেন ক্যাম্পাসের জি এল (গোপাল লাল) ছাত্রাবাসের উত্তর-দক্ষিণে অবস্থিত টিনশেডের একটি কক্ষে। ওই দিন রাতে হানাদার বাহিনী বেশ কয়েকজন অধ্যাপককে ধরে নিয়ে যায়। রামকৃষ্ণ অধিকারী ছিলেন তাঁদের একজন। ঘাতকেরা কলেজ থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের পাশে দমদমা সেতুর কাছে নিয়ে ওই রাতেই তাঁদের গুলি করে হত্যা করে। দমদমার আশপাশের মানুষ এ হত্যাকাণ্ড দেখেছে। পরে সেখানেই রামকৃষ্ণ অধিকারীর মরদেহ পাওয়া যায়।

দমদমার বধ্যভূমিটি এখনো অরক্ষিত, অযত্ন আর অবহেলায় পড়ে আছে। দেশের অনেক বরেণ্য ব্যক্তিসহ রংপুরের স্থানীয় প্রশাসন ও কলেজ কর্তৃপক্ষ একাধিকবার দমদমা বধ্যভূমি পরিদর্শন করেছে। তারা বধ্যভূমিটি সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছে। কারমাইকেল কলেজের প্রশাসনিক ভবনের সামনে শহীদের স্মরণে একটি নামফলক তৈরি করা হয়েছে। সেখানে অধ্যাপক রামকৃষ্ণ অধিকারীর নাম রয়েছে।

গ্রন্থ: আরিফুল হক, নিজস্ব প্রতিবেদক, রংপুর