বিজ্ঞাপন
default-image

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে দিনাজপুর শহর ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। হাতে গোনা যে কয়েকজন তখন শহরে ছিলেন, তাঁদের মধ্যে মো. খোরশেদ আলী সরকার একজন।

এপ্রিলের ১৩-১৪ তারিখের দিকে রাস্তায় গুলির শব্দ শুনে তিনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় গিয়েছিলেন।

তখনই কিছু অবাঙালি যুবক পাকিস্তানি সেনাদের তাঁকে দেখিয়ে দেয়। সেনারা পেছন থেকে অব্যর্থ গুলি করেছিল।

গুলিবিদ্ধ হওয়ার কিছুক্ষণ পর তিনি মারা যান। তাঁর মরদেহ পাওয়া যায়নি। তবে বাঁকা চশমা ও হাতের আংটি দেখে তাঁর কঙ্কাল শনাক্ত করা হয়েছিল।

এ ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায় তাঁর ছেলে শওকত আলীর ‘আমার বাবা’ রচনায়। তিনি লিখেছেন, ‘দিনাজপুর শহরের প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে এপ্রিলের ১২/১৩ তারিখের দিকে।

শহরের লোক ঊর্ধ্বশ্বাসে পালায়। পাকিস্তানি বাহিনীর লোকেরা শহরে ঢোকে বন্দুক উঁচিয়ে। নড়াচড়া করতে দেখলেই গুলি মেরে উড়িয়ে দেয় যেকোনো জিনিস। তা সেটা গাছপালা হোক, কি মানুষ হোক, কি কুকুর–বেড়াল হোক।

‘সবাই পালিয়েছিল, স্ত্রী-পুত্র, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, নেতা-কর্মী, পুলিশ, দারোগা, উকিল, ম্যাজিস্ট্রেট—বলা যায় শহরের প্রায় সকলেই।

শুধু আমার জেদী একরোখা বাবা যাননি। নাকি বলেছিলেন, এটা আমার বাড়ি, এ জায়গা আমার, আমি কেন পালাবো? আমি যাবো না, তোমরা যাও।

‘সেদিন, ১৩ কি ১৪ তারিখ এপ্রিলের, সকাল বেলাতেই তাঁর প্রায় বধির কানে গুলির আওয়াজ আসে। বোধহয় ঘটনাটা কি ঘটেছে দেখার কৌতূহল হয়েছিল তাঁর।

চোখে কম দেখতেন, তবু। নইলে অমন সময় কেউ রাস্তায় বের হয়?...

‘ঐ সময় গলির মোড়ে দাঁড়ানো দু’তিনটি অবাঙালি যুবক বাবাকে চিনতে পারে। কারণ আমার বাবা গরিব মোহাজেরদের কাছ থেকে চিকিৎসার জন্য পয়সা নিতেন না বলে ভালোরকম পরিচিত ছিলেন।

তারাই নাকি বুড়ো লোকটিকে দেখিয়ে দেয়—উয়ো দেখো, ডাকটর সালে ভাগ রাহা। তখন আর দেরি হয় না। পাকিস্তানি সৈনিকটি সঠিক নিশানা করতে একটুও ভুল করে না।

পেছন থেকে গুলি এসে লাগে বাবার কাঁধে।...জানালার আড়াল থেকে দৃশ্যটা দেখেন কালাম সাহেবের স্ত্রী।’ (স্মৃতি: ১৯৭১, চতুর্থ খণ্ড, প্রকাশ ১৯৯১, সম্পাদনা রশীদ হায়দার)।’

মো. খোরশেদ আলী সরকারের আদি পৈতৃক নিবাস ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম দিনাজপুরে।

১৯৫২ সালে বাংলাদেশের দিনাজপুরে চলে আসেন। তিনি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও প্রখর রাজনৈতিক সচেতন ছিলেন।

১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচিত হলে বাঙালিদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দেখে আশান্বিত হয়ে উঠেছিলেন।

কিন্তু কিছুদিন পর পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার নিরাপত্তা আইনের ৯২-ক ধারা দিয়ে সে অধিকার কেড়ে নিলে তিনি ভীষণ আশাহত হয়েছিলেন।

মো. খোরশেদ আলী সরকার পশ্চিম দিনাজপুর থেকে নিবাস উঠিয়ে নিয়ে আসায় প্রায় নিঃস্ব হয়ে পড়েছিলেন।

হোমিওপ্যাথি পেশা ছিল তাঁর আয়ের উৎস। এর আয়েই চলত তাঁর সংসার। তার পরও স্থানীয় অনেক মানুষকে বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা দিতেন তিনি।

এদের মধ্যে অবাঙালিরাও ছিল। অভাব সত্ত্বেও তাঁর বাড়িতে কলকাতা থেকে কাগজ ও পত্রিকা আসত তিন-চারটি।

পড়তেন খুব মনোযোগ দিয়ে। বই পড়তেন প্রচুর। শেষ বয়সে চোখে ছানি পড়েছিল, তবু ক্ষীণ দৃষ্টি নিয়েই পড়াশোনা অব্যাহত রাখেন।

মো. খোরশেদ আলী সরকার ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থী হওয়া সত্ত্বেও স্বদেশি আন্দোলনের ডাকে আর পরীক্ষা দেননি। পরে হোমিওপ্যাথি শিক্ষা লাভ করেছিলেন। তিনি পাঁচ ছেলেমেয়ের জনক। তাঁর বাবা সহর আলী প্রধান।

স্কেচ: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (সপ্তম পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯৮) থেকে।

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান

সূত্র: ২২ জানুয়ারি, ২০১৫ সালে প্রথম আলোতে প্রকাশিত