বিজ্ঞাপন
default-image

শহীদ আলী করিমের যুদ্ধটা ছিল অন্য রকম। তাঁর তিন ছেলে গিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। তাঁরা ছিলেন সম্মুখযোদ্ধা। আর আলী করিম মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করার পাশাপাশি নিজে যুদ্ধ করছিলেন দারিদ্র্যের সঙ্গে। সেই যুদ্ধ শুরু হয়েছিল তাঁর জীবনের শুরু থেকেই। শহীদও হয়ে গেলেন সেই যুদ্ধের তাগিদেই।

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার বদরপুর গ্রামে জন্ম আলী করিমের। কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়ে বছরখানেক পড়ালেখাও করেছিলেন। কিন্তু অভাব–অনটনে আর পাঠ শেষ করতে পারেননি। পরে অবশ্য স্নাতক ডিগ্রি নেন। ১৯৪২ সালে তিনি যোগ দিয়েছিলেন আসাম বেঙ্গল রেলওয়েতে। চাকরিজীবনে আসাম, লামডিং, তিনষোফিয়া হয়ে ১৯৪৭ সালে তিনি বদলি হয়ে আসেন চট্টগ্রামে। অফিস সুপারিনটেনডেন্ট হিসেবে সেখানেই কর্মরত ছিলেন শেষ পর্যন্ত।

রাজনীতিসচেতন মানুষ ছিলেন। সোনাইমুড়ী হাইস্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় মাস্টারদা সূর্য সেনের সাহচর্যে এসে যোগ দেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে। পরে তিনি সন্তানদের জানিয়েছেন সোনাইমুড়ী রেলস্টেশনের উত্তরে ধুরমসী সেতুর তলায় ব্রিটিশবিরোধী গুপ্ত সংগঠন ‘অনুশীলন’–এর গোপন সভায় যোগ দেওয়ার কথা।

রেলে চাকরি করলেও আর্থিকভাবে খুব একটা সচ্ছল ছিলেন না আলী করিম। তাঁর সাত সন্তানের পরিবার। বড় তিন ছেলেকে পাঠিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। চট্টগ্রামের পাহাড়তলীর রেলের আবাসনে থাকতেন তিনি। সেখানে গোপনে তরুণদের সংগঠিত করে মুক্তিযুদ্ধে যেতে অনুপ্রেরণা দিতেন।

আলী করিমের ছেলে মুক্তিযোদ্ধা গাজী সালেহউদ্দিন বাবা সম্পর্কে এমন অনেক কথা তুলে ধরেছেন স্মৃতি: ১৯৭১-এ প্রকাশিত লেখায় (রশীদ হায়দার সম্পাদিত, পুনর্বিন্যাসকৃত তৃতীয় খণ্ড, বাংলা একাডেমি)। এ ছাড়া ডাক বিভাগের স্মারক ডাকটিকিটের স্মরণিকা থেকে তাঁর সম্পর্কে জানা যায়।

সালেহউদ্দিন বইয়ে লিখেছেন, ‘তখন রাত আনুমানিক ১০টা, আমিনপাড়া এলাকায় একটি ক্যাম্পে ছিলাম। তিন ভাই ছুটলাম বাড়ির দিকে, বাড়িতে কান্নার রোল। ছোট ভাই গাজী কামাল উদ্দিন কামরান ঘাতকদের হাত থেকে বেঁচে ফিরে এসেছে। ক্লাস ফোরে পড়ে। তার কাছ থেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবই জিজ্ঞেস করছি ঘটনা সম্পর্কে। মা বেহুঁশ হয়ে পড়ে রয়েছে।’

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সবাই এলাকা ছেড়ে গেলেও পাহাড়তলীর রেল কলোনিতেই ছিলেন আলী করিম। তাঁর ছোট ভাই আলী হোসেন ইস্পাহানি কোম্পানিতে চাকরি করতেন, তিনিও সেখানে থাকতেন। ১০ নভেম্বর রেলের অবাঙালিরা পাকিস্তানি সৈনিকদের কাছে আলী করিম, ছোট ছেলে কামরান, ভাই আলী হোসেনসহ অনেককে ধরিয়ে দেয়। তাঁদের বাড়ি লুট করে পুড়িয়ে দেয়। পরে আলী করিমসহ অনেককে ধরে এনে পাহাড়তলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয় মাঠে লাইন করে দাঁড় করানো হয়। প্রচণ্ড নির্যাতন চালানো হয় তাঁদের ওপর। একপর্যায়ে তাঁদের কাউকে জবাই করে, কাউকে ছুরি দিয়ে পেট কেটে হত্যা করা হয়। আলী করিমের হাত তাঁর শার্ট দিয়ে পিছমোড়া করে বেঁধে জবাই করে হত্যা করা হয়েছিল। কামরান এক ফাঁকে পালিয়ে আসে।

গাজী সালেহউদ্দিন পরে চট্টগ্রামে গিয়েছিলেন বাবা ও চাচার লাশের খোঁজে। তবে বধ্যভূমিতে তিনি যেতে পারেননি। আলী করিমের সন্তানেরা জানতে পারেননি তাঁদের বাবা–চাচার অন্তিম শয্যা কোথায়।

গ্রন্থনা: আশীষ-উর-রহমান