বিজ্ঞাপন
default-image

ডেমরা থেকে নৌকায় উঠেছেন, যাবেন নরসিংদী। নদীতে তখন ভয়াবহ দৃশ্য। শিশু, নারী-পুরুষের অসংখ্য মৃতদেহ ভাসছে, ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। সেই দৃশ্য যেন চোখে না পড়ে, তাই হাত দিয়ে স্ত্রীর চোখ ঢেকে দিলেন এ বি এম আবদুর রহিম। আরও অগুনতি মানুষের সঙ্গে তাঁরাও সপরিবার ঢাকা থেকে পালিয়ে যাচ্ছিলেন। সেদিন ছিল একাত্তরের ২৬ মার্চ।

শহীদ আবদুর রহিম ছিলেন শ্রমবিষয়ক আইনজীবী, যুক্ত ছিলেন শ্রমিক আন্দোলনে। ছাত্রজীবন থেকেই প্রগতিশীল রাজনীতিতে
জড়িত ছিলেন। জেলও খেটেছেন। শ্রমিকদের পক্ষে মামলা পরিচালনায় কোনো পারিশ্রমিক নিতেন না তিনি। থাকতেন ঢাকায় তৎকালীন ডিআইটি রোডের এক বাসায়।

আবদুর রহিমের জন্ম ১৯৩৬ সালের ২ জানুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘাটিয়ারায়। ঝর্ণা রহিম আমার স্বামী নামের স্মৃতিকথায় লিখেছেন, (স্মৃতি: ১৯৭১, সম্পাদনা রশীদ হায়দার, পুনর্বিন্যাসকৃত দ্বিতীয় খণ্ড, বাংলা একাডেমি) ‘২৫শে মার্চ রাতে তাঁকে দেখে আমি খুব আশ্চর্য হই। সে তখন খুবই অস্থির।...আমাদের বাসার সামনে সে আমাদের জাতীয় পতাকা উড়িয়ে রেখেছে। বাসাটি ছিল ডিআইটি রোডে। একেবারে রাস্তার পাশে।’

রাত নয়টার দিকে তিনি বাসার নিচে নেমেছিলেন লোকজন নিয়ে পথে প্রতিবন্ধক তৈরি করতে। ফিরে ছিলেন রাত ১২টার দিকে। ঝর্ণা রহিম তাঁর লেখায় বলেছেন, নরসিংদী তাঁর বাবার বাড়ি। পরদিন আবদুর রহিম ডেমরা হয়ে মেঘনায় নৌকা দিয়ে তাঁদের নরসিংদীতে নিয়ে আসেন। মেঘনায় তখন অসংখ্য লাশ ভাসছিল। আবদুর রহিম স্ত্রী-সন্তানদের রেখে ঢাকায় ফিরে আসেন।

ঢাকায় তিনি শ্রমিকদের নিয়ে গোপনে বৈঠক করে মুক্তিযুদ্ধের জন্য তাঁদের সংগঠিত করতেন। প্রশিক্ষণের জন্য গোপনে ভারতে পাঠানোর কাজ করতেন। নিজেও প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ভারতে যাওয়ার। কিন্তু তার আগেই ৫ মে পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে তাঁর কর্মস্থল (উজালা ম্যাচ ফ্যাক্টরি) থেকে তুলে নিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত ঘাতকেরা তাঁকে আর ছেড়ে দেয়নি। কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি আর এই সাহসী মানুষটির।

আবদুর রহিমের বড় ছেলে এ বি এম সোহেল রশিদ তাঁর মাকে নিয়ে ঢাকায় আদাবরের শেখেরটেকে ভাড়া বাড়িতে থাকেন। পেশায় তিনি অভিনেতা। প্রথম আলোকে সোহেল জানালেন, বাবা শহীদ হওয়ার পরে তাঁর মা ঝর্ণা রহিম খুব কষ্ট করে তাঁদের পাঁচ ভাইবোনকে পড়ালেখা করিয়েছেন। চার ভাইবোন প্রবাসী।

সোহেল রশিদ বললেন, স্বাধীনতার পর তিনি ও তাঁর মা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু দুই হাজার টাকা দিয়েছিলেন। বুদ্ধিজীবী পরিবারের অনেকে ঢাকায় পরিত্যক্ত বাড়ির বরাদ্দ পেলেও তাঁরা পাননি। তাঁর বাবার নামে কোনো স্বীকৃতিও নেই। তিনি খেদের সঙ্গে বললেন, নেতা-এমপিদের নামে একাধিক স্কুল, রাস্তাঘাটের নামকরণ হচ্ছে অথচ শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম এখন মানুষের মনেও নেই। অন্তত তাঁদের নামটি মানুষের স্মরণে রাখার জন্য কোনো উদ্যোগ নিলে শহীদ পরিবারগুলো সান্ত্বনা পেত।

গ্রন্থনা: আশীষ-উর-রহমান