বিজ্ঞাপন
default-image

‘ভোররাতের কিছু আগে। অন্ধকার ফিকে হয়ে আসতে শুরু করেছে। লাইন দিয়ে গ্রামে ঢুকতে থাকে পাকিস্তানি বাহিনী। মেশিনগানের সাথে দুই চাকা দিয়ে টেনে আনে কামান। ভোরের আলো ফুটে ওঠার আগেই শুরু হয় গুলি। বৃষ্টির মতো গুলি ছুটতে থাকে। সাথে সাথে আর্তনাদ।’ বলছিলেন জান্দী গ্রামের বাসিন্দা বিপ্লব মিত্র।

৬০ বছর বয়সী বিপ্লব মিত্র বর্তমানে ভাঙ্গা কেএম কলেজের সহকারী অধ্যাপক ও বাংলা বিভাগের প্রধান। একাত্তরে তাঁর বয়স ছিল ১৪, তখন তিনি নবম শ্রেণির ছাত্র। জান্দী গ্রামে গণহত্যার অনেক কিছুই তাঁর স্পষ্ট মনে আছে।

ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার তুজারপুর ইউনিয়নের বর্ধিষ্ণু গ্রাম জান্দী। মুক্তিযুদ্ধের সময় শহরগুলো দখল হয়ে যেতে শুরু করলে মানুষ ছুটতে থাকে গ্রামের দিকে। নিরাপত্তার খোঁজে প্রত্যন্ত অঞ্চলের হিন্দু-অধ্যুষিত ওই গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিলেন অনেকে।

১৯৭১ সালের ২ মে ভোররাতে পাকিস্তানি বাহিনী কামান ও মেশিনগান নিয়ে হামলা করে জান্দী গ্রামে। তাদের হামলার মূল লক্ষ্য ছিল জমিদার কালীমোহন সেনের বাড়ি।

বিপ্লব মিত্র বলেন, ‘গণহত্যার আগের দিন আমি সন্ধ্যার আগে আগে বাড়ি ফিরছিলাম। উঁচা বাজারের খাল পার হয়ে দেখলাম ইঙ্গুল কাজী (এমদাদ কাজী) জসীম মাতুব্বরের সাথে কথা বলছেন। ইঙ্গুল কাজী চলে গেলে জসীম মাতুব্বর আমাকে জানান, আজ রাতে মিলিটারি আসবে এলাকার পরিবহন ব্যবসায়ী টনিক সেনসহ আশপাশের যেসব লোক আছে তাদের মারার জন্য। তোরা সবাই সরে পড়। আমরা ফুকুরহাটি খাল পার হয়ে পাশের গঙ্গাধরদি গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নিই। তবে বাবা জগদীশচন্দ্র মিত্র বাড়িতেই থেকে যান।’

প্রথম আক্রমণ হয় বণিকপাড়ায় কালীমোহন সেনের বাড়িতে। সেখানে টনিক সেন ও তাঁর স্বজনেরা আশ্রয় নিয়েছিলেন। টনিক সেনকে গুলি ও বেয়নেট দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। তাঁর বাবা উপেন সেন ও দুই ভাগনে শহীদ হন। এর মধ্যে টনিক সেনের ভাগনে সুকেশ সেন ছিলেন ফুটবল খেলোয়াড়। কালীমোহন সেনের বাড়িতে ওই দিন একসঙ্গে ১৮ জন ব্যক্তিকে ধুতি দিয়ে বেঁধে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করা হয়। পরে বেয়নেট দিয়ে কোপানো হয়। ১৭ জন ঘটনাস্থলেই নিহত হন। তবে একজন সেদিনের মতো বেঁচে গিয়েছিলেন। তিনি ব্যবসায়ী রতিকান্ত চন্দ্র।

রতিকান্তের ভাতিজা অনিল চন্দ্র মরণ বর্তমানে ভাঙ্গার জ্যেষ্ঠ সহকারী জজ আদালতে আইন ব্যবসা করেন। তিনি বলেন, ‘জ্যেঠার গায়ে গুলি লাগেনি। তবে তাঁর ঘাড়ের বাঁ দিকে বেয়নেটের আঘাত ছিল। তাঁকে আমরা গ্রামে রেখেই চিকিৎসা করাই। কিন্তু বাঁচাতে পারিনি। ঘটনার দুই মাস পর মারা যান তিনি।’

জীবনকৃষ্ণ সেন ও তাঁর ভাই মঙ্গলচরণ সেনকে ধুতি দিয়ে পিঠাপিঠি বেঁধে একটি গুলিতেই হত্যা করা হয়। গুলিটি মঙ্গল সেনের বুক দিয়ে ঢুকে জীবনের বুক ভেদ করে চলে যায়।

ওই দিন নিহত হয়েছিলেন কালীপদ চত্রবর্ত্তী নামের এক পূজারি ব্রাহ্মণ। কালীমোহন সেনের বাড়িতে হত্যাযজ্ঞ শেষ করে পাকিস্তানি বাহিনী সারা গ্রামে তাণ্ডব চালায়। খালের পাড়, জমির আইল, বাঁশবাগান কিছুই বাদ যায়নি। কালীপদকে হত্যা করা হয় জমির একটি আইলে। তাঁর লাশ পড়ে ছিল কয়েক দিন।

কালীপদের ভাতিজা বাদল চক্রবর্ত্তী জানান, ইঙ্গুল কাজী পাকিস্তানি বাহিনী নিয়ে আসে। হত্যাকাণ্ডের আগের দিন এসে তিনি টনিক সেনের অবস্থান দেখে যান।

জান্দী গ্রামের পোদ্দার বাজারের পাশে ছিল একটি আশ্রম। ওই আশ্রমের মহারাজ সনৎ মহারাজকে পূজারত অবস্থায় গুলি করে হত্যা করা হয়।

গণহত্যার সময় বাড়িতে বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। পাকিস্তানি বাহিনী চলে যাওয়ার পর আশপাশের গ্রামের রাজাকাররা এসে শুরু করে লুটতরাজ।

গণহত্যার দেড় দিন পর ৩ মে বিকেলে বড় একটি গর্ত খুঁড়ে লাশগুলো মাটি চাপা দেওয়া হয়। ওই স্থানেই পরবর্তী সময়ে ৩৫ বছর পর ২০০৬ সালে নির্মাণ করা হয় স্মৃতিস্তম্ভ।

পল্লি চিকিৎসক এমদাদ কাজী ওরফে ইঙ্গুল কাজী বেশ কিছু টাকা ধার নিয়েছিলেন টনিক সেনের কাছ থেকে। কারও কারও মতে, টাকার পরিমাণ ৫০ হাজার। অভিযোগ আছে, এই অর্থ ফেরত দেওয়া থেকে রেহাই পেতেই গুজব রটিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীকে গ্রামে ডেকে এনেছিলেন এমদাদ কাজী।

মৃতের সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি

জান্দী গ্রামের স্মৃতিস্তম্ভে ২৫ জনের নামের একটি তালিকা রয়েছে। এ ছাড়া লেখা রয়েছে ‘আরও নাম না জানা অনেকে’।

অনিল চন্দ্র মরণ জানান, শহীদ হয়েছেন ৩১ জন। অপরদিকে ভাঙ্গা কেএম কলেজের বিপ্লব মিত্র জানান, ওই দিন মারা গেছেন ৪২ জন। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি ৪২ জন শহীদের একটি তালিকা করে জমা দিয়েছিলেন তাৎকালীন ইউপি চেয়ারম্যানের কাছে। চেয়ারম্যান সেটি হারিয়ে ফেলেন।

আবু সাঈদ খান রচিত মুক্তিযুদ্ধে ফরিদপুর গ্রন্থে ওই মৃতের সংখ্যা ৩১ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলা একাডেমির বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালার ফরিদপুর অংশে কালীমোহন সেনের বাড়িতে শুধু ১৭ জন নিহত হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

এই গণহত্যার জন্য এলাকাবাসী জান্দী গ্রামসংলগ্ন নওপাড়া গ্রামের পল্লি চিকিৎসক এমদাদ কাজী ওরফে ইঙ্গুল কাজীকে দায়ী করেন। ২০১০ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম শুরু হলে অশীতিপর এমদাদ কাজীকে তাঁর নিজ বাড়িতে নজরবন্দি করে রাখে গোয়েন্দা পুলিশ। ধারণা করা হয়েছিল, তাঁর বিচার হবে। তবে তার আগেই ২০১৫ সালে নিজ বাড়িতে মারা যান এমদাদ কাজী।