টাঙ্গাইলজলার কালিহাতী উপজেলার একটি গ্রাম বল্লা। ১৯৭১ সালের জুন মাসের মাঝামাঝি সময় সেখানে কয়েক দিন ধরে অবস্থান করছেন হামিদুল হকসহ একদল মুক্তিযোদ্ধা। সকাল আটটার দিকে মুক্তিযোদ্ধারা খবর পেলেন ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত একদল পাকিস্তানি সেনা কালিহাতী থেকে এগিয়ে আসছে বল্লার দিকে। যে পথে আসছে, সে পথে আছে নদী।
হামিদুল হকসহ মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান নিলেন নদী তীরে আড়ালে। নদীর ওপাড় থেকে তাঁদের দেখা যায় না। মুক্তিযোদ্ধারা বসে আছেন টানটান উত্তেজনা নিয়ে। সবার চোখ নদীর ওপাড়ে। একটু পর সেখানে হাজির হলো পাকিস্তানি সেনারা।
মুক্তিযোদ্ধারা সবাই নিশ্চুপ। পাকিস্তানি সেনারা কোথাও কোনো বাধা পায়নি। ঘাটে তারা কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে নৌকায় উঠল। তারপর নৌকা চলতে শুরু করল। সেনারা সবাই নৌকায় নিশ্চিত মনে দাঁড়িয়ে। তারা বুঝতেও পারল না নদীর এপাড়ে তাদের জন্য কী ঘটনা অপেক্ষা করছে।
নৌকা নদীর এপাড়ে আসামাত্র গর্জে উঠল মুক্তিযোদ্ধা কয়েকজনের অস্ত্র। সবাই গুলি করলেন না। তাঁদের ওপর নির্দেশ, এমনভাবে গুলি করতে হবে যাতে সব নিশানাই সঠিক হয়। এলোপাতাড়ি গুলি করে গুলির অপচয় করা যাবে না। কারণ তাঁদের অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদের অভাব প্রকট।
আক্রমণের প্রথম ধাক্কাতেই সেনাদের ছোটাছুটিতে ডুবে গেল দুটি নৌকা। ঝাঁপাঝাঁপি করে পানি থেকে উঠে তারা অবস্থান নিল বিভিন্ন স্থানে। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রের গুলিতে নিহত হয়েছে চারজন পাকিস্তানি সেনা। কয়েকজন নদীতে হাবুডুবু খাচ্ছে।
একটু পর শুরু হলো পাকিস্তানি সেনাদের পাল্টা আক্রমণ। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের তুলনায় অনেক শক্তিশালী ও প্রশিক্ষিত। অন্যদিকে হামিদুল হক ও তাঁর বেশির ভাগ সঙ্গী মাত্র কয়েক দিনের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। পাকিস্তানি সেনাদের পাল্টা আক্রমণ বেশ বেপরোয়া ধরনের। এতে মুক্তিযোদ্ধারা বিচলিত হলেন না। স্বল্প প্রশিক্ষণ, অস্ত্র ও গোলাবারুদ সম্বল করেই সাহসের সঙ্গে তাঁরা পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ প্রতিহত করতে থাকলেন।
হামিদুল হক ও তাঁর সহযোদ্ধাদের বীরত্বে পাকিস্তানি সেনারা ভড়কে গেল। অবস্থা বেগতিক বুঝে তারা পিছু হটতে শুরু করল। পিছু হটার আগে তারা চেষ্টা করল নিহত সহযোদ্ধাদের লাশ উদ্ধারে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের ত্বরিত তত্পরতায় তাদের সে প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হলো। পাঁচ ঘণ্টা যুদ্ধের পর তারা পালিয়ে গেল।
হামিদুল হক ১৯৭১ সালে উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে দেশের অভ্যন্তরে টাঙ্গাইলে গঠিত কাদেরিয়া বাহিনীতে যোগ দিয়ে বল্লাসহ আরও কয়েকটি জায়গায় যুদ্ধ করেন তিনি। পাশাপাশি কাদেরিয়া বাহিনীর বেসামরিক বিভাগেরও গুরুত্বপূর্ণ কিছু দায়িত্ব পালন করেন।
সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, দ্বিতীয় খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১৩
সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান