২০-২৫ মিনিট যুদ্ধ করার পর পাকিস্তানি সেনা ও তাদের সহযোগীরা পালাতে শুরু করল। দুই ঘণ্টার মধ্যেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ঘাঁটি মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে চলে এল। ঘাঁটিতে উড়ছিল পাকিস্তানি পতাকা। মুক্তিযোদ্ধা শফিকউদ্দীন আহমেদের কাছে ছিল বাংলাদেশের পতাকা। তিনি পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা ওড়ালেন। মুক্তিযোদ্ধারা আনন্দে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে গোটা এলাকা মুখরিত করলেন। কিন্তু তাঁদের এই আনন্দ বেশিক্ষণ থাকল না।
কিছুক্ষণের মধ্যেই পাকিস্তানি সেনারা এসে প্রচণ্ড আক্রমণ শুরু করল। আবারও শুরু হলো প্রচণ্ড যুদ্ধ। কয়েক ঘণ্টা যুদ্ধ চলার পর মুক্তিযোদ্ধাদের গোলাবারুদ প্রায় শেষ হয়ে গেলে তাঁদের অধিনায়ক পিছিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। দলের বেশির ভাগ যোদ্ধা পশ্চাদপসরণ করে নিরাপদ স্থানে চলে গেছেন। শফিকউদ্দীন আহমেদ ও তাঁর সঙ্গে থাকা কয়েকজন সময়মতো সে খবর পাননি। তিনি সেখানে একটি টিলার ফাঁকে হালকা মেশিনগান দিয়ে যুদ্ধ করে যাচ্ছিলেন; কিন্তু পাকিস্তানি সেনাদের প্রচণ্ড আক্রমণে ক্রমে তাঁরা কোণঠাসা হয়ে পড়লেন। চোখের সামনে শহীদ হলেন সহযোদ্ধা ইপিআরের হাবিলদার কুতুবউদ্দীন (বাড়ি বিয়ানীবাজারের ঘোলাটিকর), নায়েক আবদুল মান্নান (বাড়ি গোলাপগঞ্জের হেতিমগঞ্জ) এবং কামাল চৌধুরী (বাড়ি গোলাপগঞ্জের লক্ষ্মীপাশা)। এ অবস্থায় শফিকউদ্দীনসহ যাঁরা বেঁচে ছিলেন, তাঁদের পিছিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। তখন সেখানে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া মানে নিশ্চিত মৃত্যু। এরপর তিনি বেঁচে যাওয়া সহযোদ্ধাদের নিয়ে নিরাপদ স্থানে সরে যান।
এ ঘটনা ঘটে মৌলভীবাজার জেলার লাতুতে। সেখানে ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের একটি কোম্পানি। তাদের সহযোগী হিসেবে ছিল স্কাউট ও রাজাকাররা। ১০ আগস্ট মুক্তিবাহিনী সেখানে আক্রমণ করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী তাঁরা ভোর সাড়ে পাঁচটায় একযোগে আক্রমণ চালান। এর আগে কয়েক ঘণ্টা পাকিস্তানি অবস্থানে আর্টিলারি থেকে গোলাবর্ষণ করা হয়। আটটার মধ্যে লাতু রেলস্টেশন এলাকা মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে। এখানেই ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ঘাঁটি।
শফিকউদ্দীন আহমেদ ইপিআরে চাকরি করতেন। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন সিলেট সেক্টর হেডকোয়ার্টারের অধীনে ১ নম্বর উইংয়ে। এ উইংয়ের অবস্থান ছিল কুমিল্লার কোটবাড়ীতে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি কোটবাড়ী থেকে পালিয়ে নিজ এলাকায় প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নেন। পরে ভারতে গিয়ে যোগ দেন মুক্তিবাহিনীতে। যুদ্ধ করেন ৪ নম্বর সেক্টরের বড়পুঞ্জি সাব-সেক্টরে। জুড়ী উপজেলার দিলকুশা চা-বাগানে সম্মুখযুদ্ধে তিনি এক পাকিস্তানি সেনাকে আটক করেন।
সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, প্রথম খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১২
সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান