বিজ্ঞাপন
default-image

লাতু মৌলভীবাজারের বড়লেখা থানার শাহবাজপুরের অন্তর্গত। এখানে ছিল একটি রেলস্টেশন। ১৯৭১ সালে এখানে ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর শক্তিশালী একটি ঘাঁটি। বড়পুঞ্জি সাব-সেক্টরের অধিনায়ক ক্যাপ্টেন আবদুর রবের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি দল ১০ আগস্ট লাতুতে আক্রমণ করে। এই দলে ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা রাসিব আলী।

রাসিব আলী এখন বেঁচে নেই। তাঁর সহযোদ্ধা ও ছোট ভাই মুক্তিযোদ্ধা আজমল আলী এ ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ‘তখন আগস্ট মাস। বর্ষা মৌসুম। প্রতিদিন অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। এক দিন ক্যাপ্টেন আবদুর রবের নেতৃত্বে আমরা শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা বড়পুঞ্জি ক্যাম্প থেকে যাই পাকিস্তানি সেনাদের লাতু ক্যাম্পে আক্রমণ করতে। আমরা কয়েকটি দলে বিভক্ত ছিলাম। রাসিব ভাই একটি দলের নেতৃত্বে। তাঁর ছিলাম আমি। পরিকল্পনামতো বিকেলে শুরু হয় আক্রমণ। বৃষ্টির মধ্যেই আমরা চলে যাই পাকিস্তানি ক্যাম্পের একদম কাছে। আমাদের আক্রমণে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদেরও কয়েকজন শহীদ হন। এ সময় খবর আসে, পাকিস্তানি সেনাদের নতুন একটি দল আমাদের আক্রমণ করার জন্য সেখানে এসেছে। তখন অধিনায়ক আমাদের পেছনে যেতে বলেন। আমরা গুলি করতে করতে পেছনে যেতে থাকি। পাকিস্তানি সেনারা আমাদের ধাওয়া করে। তখন রাসিব ভাই কয়েকজন সহযোদ্ধাসহ নর্দমায় পড়ে যান।’

রাসিব আলী ও সহযোদ্ধারা ওই নর্দমা থেকে আর ওপরে উঠতে পারছিলেন না। এদিকে একটু দূরেই ছিল পাকিস্তানি সেনারা। ওই অবস্থাতেই রাসিব আলী ব্রাশফায়ার করেন পাকিস্তানি সেনাদের লক্ষ্য করে। এতে নিহত হয় পাঁচজন পাকিস্তানি সেনা। বাকি সেনারা তখন পালিয়ে যায়। এরপর অনেক কষ্টে ওই নর্দমা থেকে তাঁরা উঠে নিরাপদে ক্যাম্পে ফিরতে সক্ষম হন।

১০ আগস্ট সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে লাতু রেলস্টেশন থেকে পাকিস্তানি সেনাদের বড় একটি অংশ পালিয়ে যায়। বাকিরা মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ যুদ্ধ করলেও শেষ পর্যন্ত তাদের বেশির ভাগই হতাহত হয়ে অবস্থান ত্যাগ করে। মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি ক্যাম্পে উড্ডীন পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা উত্তোলন করেন। ঠিক তখনই খবর আসে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নতুন একটি দল তাঁদের আক্রমণ করার জন্য দ্রুত এগিয়ে আসছে। সম্ভাব্য এই আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের যে দলের (কাট অফ পার্টি) ওপর দায়িত্ব ছিল, তাঁরা তা করতে ব্যর্থ হন। অগ্রসরমাণ পাকিস্তানি সেনারা লাতুতে ব্যাপক গোলাবর্ষণ শুরু করে। এ অবস্থায় ক্যাপ্টেন আবদুর রব সেখান থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের পশ্চাদপসরণের নির্দেশ দেন। এ যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। মুক্তিবাহিনীর কুতুবউদ্দিন, মান্নান, ফয়েজসহ ছয়জন শহীদ ও পাঁচজন আহত হন।

রাসিব আলী চাকরি করতেন ইপিআরে। ১৯৭১ সালে তিনিসহ অনেক বাঙালি ইপিআর সদস্য কর্মরত ছিলেন ঢাকার গভর্নর হাউসে (বর্তমান বঙ্গভবন)। ২৬ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বালুচ রেজিমেন্টের একটি দল তাঁদের ঘেরাও করে অস্ত্র জমা দিতে বলে। কিন্তু তাঁরা অস্ত্র জমা দিতে অস্বীকার করেন। পরে বাঙালি সুবেদারের নির্দেশে তাঁরা অস্ত্র জমা দেন। ২৭ মার্চ কারফিউ শিথিল হলে বেশির ভাগ বাঙালি ইপিআর সদস্য গভর্নর হাউস থেকে পালিয়ে যান। রাসিব আলীও পালাতে সক্ষম হন। বাড়ি ফিরে যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। যুদ্ধ করেন মুক্তিবাহিনীর ৪ নম্বর সেক্টরের বড়পুঞ্জি সাব-সেক্টর এলাকায়। কানাইঘাট থানা আক্রমণে তিনি আহত হন।

সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, প্রথম খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১২

সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান