বিজ্ঞাপন
default-image

মোহাম্মদ সোলায়মান ১৯৭১ সালে নীলফামারী জেলার (তখন রংপুর জেলার অন্তর্গত মহকুমা) কোতোয়ালি থানায় কর্মরত ছিলেন। সে সময় তিনি টগবগে যুবক। মাত্র এক বছর আগে পুলিশ বাহিনীতে যোগ দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার কয়েক দিন পর থানা থেকে একটি অস্ত্রসহ পালিয়ে এসে যোগ দেন স্থানীয় প্রতিরোধযোদ্ধাদের দলে। এ সময় ঠাকুরগাঁও থেকে ইপিআরের একদল সদস্যও পালিয়ে এসে স্থানীয় প্রতিরোধযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দেন। ফলে তাঁদের মনোবল আরও বেড়ে যায়।

৭ এপ্রিল সৈয়দপুর সেনানিবাসে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ট্যাংক, কামান, মেশিনগান ও অন্যান্য ভারী অস্ত্র নিয়ে তাঁদের ওপর আক্রমণ করে। তখন তাঁরা পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরোধের চেষ্টা করেন। কিন্তু ভারী অস্ত্রশস্ত্র মোকাবিলা করার ক্ষমতা তাঁদের ছিল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভেঙে পড়ে তাঁদের প্রতিরোধ। তখন তাঁরা ছত্রভঙ্গ হয়ে চলে যান বিভিন্ন দিকে। মোহাম্মদ সোলায়মান একটি দলের সঙ্গে চলে যান পঞ্চগড় এলাকায়।

সেখানে একদিন একজন মহিলা এসে তাঁদের খবর দিলেন যে পাকিস্তানি সেনারা তাঁদের বাংকারের দিকে আসছে। খবরটি সত্যি কি না, সেটি পরখ করার জন্য মোহাম্মদ সোলায়মান বাংকার থেকে উঠে এলেন এবং সামনে একটু এগোতেই একদল পাকিস্তানি সেনাকে দেখতে পেলেন। তারা তাঁর উপস্থিতি টের পেয়ে যায়। তিনি দ্রুত একটি গাছের আড়ালে অবস্থান নিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের লক্ষ্য করে তাঁর এলএমজি থেকে ব্রাশফায়ার শুরু করেন। পাকিস্তানি সেনারাও পাল্টা গুলিবর্ষণ শুরু করে। গুলির শব্দ শুনে বাংকারে থাকা তাঁর সহযোদ্ধারাও শুরু করেন গুলিবর্ষণ। এতে বেশ কজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। এ খবর পেয়ে পার্শ্ববর্তী জগদলহাটে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনারাও সেখানে ছুটে আসে। দুই পক্ষের মধ্যে শুরু হয় প্রচণ্ড যুদ্ধ। সারা রাত চলে সেই যুদ্ধ। ভোরের আলো তখন সবে ফুটতে শুরু করেছে, এ সময় এক ঝাঁক গুলি এসে লাগে মোহাম্মদ সোলায়মানের হাতে ও তাঁর এলএমজিতে। তিনি আহত হন। এ যুদ্ধে মোহাম্মদ সোলায়মান যথেষ্ট বীরত্বের পরিচয় দেন। হাসপাতালে প্রায় এক মাস চিকিত্সাধীন থাকার পর আবার তিনি যুদ্ধে যোগ দেন। পরে নভেম্বরে জগদলহাটে রেকি করার সময় পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে আক্রমণ করে। তিনি অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান। পরে সেখানে যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে সকিমউদ্দীনসহ তাঁর দুই সহযোদ্ধা শহীদ ও কয়েকজন আহত হন।

স্বাধীনতার পর তিনি দিনাজপুর শহরের মহারাজা স্কুল ক্যাম্পে ছিলেন। যুদ্ধের সময় উদ্ধার করা বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ ওই ক্যাম্পে মজুদ করা হয়েছিল। ১৯৭২ সালের ৪ জানুয়ারি সেখানে আকস্মিক বিস্ফোরণ ঘটে। সে সময় মোহাম্মদ সোলায়মান ক্যাম্পের বাইরে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান। তবে এ দুর্ঘটনায় কয়েক শ মুক্তিযোদ্ধা প্রাণ হারান। অনেকে ধরে নিয়েছিলেন, তিনিও এতে মারা গেছেন। পরে এ ঘটনার স্মরণে একটি শহীদ মিনার নির্মিত হয়। তাতে শহীদদের নাম খোদাই করা হয়েছিল। ওই তালিকায় দীর্ঘদিন তাঁর নামও ছিল। পরে অবশ্য তাঁর নাম মুছে ফেলা হয়।

সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, প্রথম খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১২

সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান