বিজ্ঞাপন
default-image

মোহাম্মদ আব্দুস সালামসহ একদল মুক্তিযোদ্ধা শেষ রাতে নিঃশব্দে হাজির হলেন একটি সেতুর ধারে। সেখানে আছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী একদল মিলিশিয়া ও রাজাকার। কৌশলে তাদের আটক করলেন তাঁরা। তারপর বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দিলেন সেতু।

এই অপারেশনের বিবরণ শোনা যাক মোহাম্মদ আব্দুস সালামের ভাষ্যে: ‘সময়টা আগস্ট মাসের তৃতীয় সপ্তাহ। সে সময় একদিন মেজর কে এম সফিউল্লাহ (বীর উত্তম, পরে মেজর জেনারেল ও সেনাপ্রধান) ক্যাম্পে এলেন। শায়েস্তাগঞ্জের পূর্ব পাশে কেরাঙ্গী নদীর ওপর দারাগাঁও রেলসেতু ধ্বংস করার পরিকল্পনা সম্পর্কে ব্রিফিং দিলেন। তাঁর ব্রিফিং শেষ হওয়ামাত্র আমি বলে উঠলাম, এই অপারেশন আমি করতে পারব। পরে সাবসেক্টর কমান্ডার আমাকে নিয়ে সম্পূর্ণ পরিকল্পনা তৈরি করে কত জনবল দরকার, কারা কারা যাবেন ইত্যাদির তালিকা করলেন।

‘আমাদের ক্যাম্প থেকে অপারেশনস্থল প্রায় ২৫ মাইল দূরে। সময় হিসাব করে দুপুর ১২টার দিকে আশ্রমবাড়ীর ক্যাম্প থেকে অ্যামবুলেন্স ও একটি ট্রাক্টরে আমরা সিন্দুরখান সীমান্তে যাই। সেখান থেকে সীমান্ত অতিক্রম করে হাঁটতে থাকি। পাহাড়ি পথ। কখনো ৩০০ ফুট উঁচুতে উঠতে হয়, কখনো সমতলে নামতে হয়। এভাবে বেলা তিনটা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত হেঁটে আমরা লক্ষ্যস্থলে পৌঁছাই।

‘সেতুর দুই পাশেই পাহারা। মিলিশিয়া ও রাজাকার মিলে ১২ জন। সেতুটি ৬০-৭০ গজ দীর্ঘ। সেখানে ঘূর্ণমান সার্চলাইট জ্বালানো। আমরা কয়েকটি দলে বিভক্ত হলাম। একটি দল গেল পশ্চিম পাশে। একটি দল পূর্ব পাশে। একটি দল থাকল বিস্ফোরক লাগানোর জন্য।

‘ক্রলিং করে সেতুর কাছে গিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পাহারারত দুই মিলিশিয়াকে কৌশলে আমরা আটক করলাম। বাকিরা ঘরের ভেতর তাস খেলছিল। তাদেরও আমরা একই কায়দায় আটক করলাম। আমাদের সংকেত পেয়ে এক্সপ্লোসিভ দল সেতুতে এক্সপ্লোসিভ লাগাতে শুরু করল। এক্সপ্লোসিভ লাগানো শেষ, এ সময় দেখি দুই রাজাকার চা নিয়ে আসছে। তাদের আমরা গুলি করে মেরে ফেললাম। আগে আটক করা ব্যক্তিদের সেতুর মাঝখানে বেঁধে রাখা হলো।

‘সেফটি কর্ডে আগুন দেওয়ার কিছুক্ষণ পরই বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটল। মনে হলো, আকাশ ভেঙে বজ্রপাত হচ্ছে। ভেঙে পড়তে থাকল লোহার গার্ডার। লোহার কিছু টুকরো উড়ে গেল আমাদের মাথার ওপর দিয়ে। সেতুটি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেল।’

মোহাম্মদ আব্দুস সালাম ১৯৭১ সালে ঢাকার জিন্নাহ (বর্তমান তিতুমীর) কলেজের স্নাতক প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তাতে যোগ দেন। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধ করেন ৩ নম্বর সেক্টরের আশ্রমবাড়ী সাবসেক্টরে।

সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, দ্বিতীয় খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১৩

সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান