মুক্তিবাহিনীর নৌ-কমান্ডোরা নির্ধারিত তারিখে বন্দরে অবস্থানরত জাহাজ মাইনের সাহায্যে ডুবিয়ে দেবেন। এ জন্য অপারেশনের আগে দিনে বন্দর ও আশপাশের এলাকা সরেজমিনে রেকি করা প্রয়োজন। দায়িত্বটা বেশ কঠিন। রেকিতে ভুল হলে মারাত্মক বিপদ হতে পারে। নৌ-কমান্ডোদের একটি দলের দলনেতা মো. শাহ আলম সিদ্ধান্ত নিলেন, এ দায়িত্ব তিনি নিজেই পালন করবেন। দক্ষতার সঙ্গে সেই দায়িত্ব পালন করে তিনি গোটা অপারেশন সফল করেন। ঘটনার আকস্মিকতায় পাকিস্তানি সেনারা হকচকিত ও কিংকর্তব্যবিমূঢ়। অন্যদিকে সারা বিশ্বে এ ঘটনা আলোড়ন সৃষ্টি করল। ১৯৭১ সালের মধ্য আগস্টে এ ঘটনা ঘটেছিল চট্টগ্রামে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ‘অপারেশন জ্যাকপট’ ঐতিহাসিক এক ঘটনা। ১৯৭১ সালে মুক্তিবাহিনীর নৌ-কমান্ডো অভিযান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নতুন মাত্রা এবং বহির্বিশ্বে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। এর আওতায় চট্টগ্রাম বন্দরে অভিযানের জন্য তিনটি দলের সমন্বয়ে কমান্ডো দল গঠন করা হয়। একটি দলের দায়িত্ব পান মো. শাহ আলম। এই অভিযানে অংশ নেওয়ার জন্য তাঁরা ভারতের পলাশি প্রশিক্ষণ ঘাঁটি থেকে ২ আগস্ট চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা হন। কথা ছিল, ১৩ ও ১৪ আগস্ট আকাশবাণী বেতারকেন্দ্র থেকে গানের মাধ্যমে দুটি ঘোষণা দেওয়া হবে। ঘোষণা দুটি শোনার পরই কমান্ডোরা অপারেশন করবেন। ঘোষণা দুটির প্রথমটি হলো পঙ্কজ মল্লিকের গাওয়া একটি গান ‘আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলেম গান’। এ গান শোনার সঙ্গে সঙ্গে কমান্ডোরা অপারেশনের প্রস্তুতি নিতে থাকবেন। দ্বিতীয় ঘোষণা সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া গান ‘আমার পুতুল আজকে যাবে শ্বশুরবাড়ি’। এ গান শোনার সঙ্গে সঙ্গে কমান্ডোরা প্রস্তুতি শেষ করে ওই দিন মধ্যরাতে পরিস্থিতি যতই প্রতিকূল হোক না কেন অপারেশন করবেন। এ সংকেত শুধু সমন্বয়ক ও দলনেতাই জানতেন, অন্য কেউ জানতেন না।
নৌ-কমান্ডোরা আগরতলা হয়ে ৮ আগস্ট ১ নম্বর সেক্টরের হরিণা ক্যাম্পে পৌঁছান। সেদিন রাতেই তাঁরা বাংলাদেশে ঢোকেন। নৌকাযোগে ও হেঁটে ১৩ আগস্ট তাঁরা চট্টগ্রাম শহরের উপকণ্ঠে পৌঁছান। পরে শহরের ভেতরে বিভিন্ন নিরাপদ বাড়িতে আশ্রয় নেন। হরিণা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত আসার পথ ছিল অত্যন্ত বিপজ্জনক।
চট্টগ্রাম শহরের সবুজবাগ হোটেলটি ছিল নৌ-কমান্ডোদের সম্মিলন কেন্দ্র। অপারেশনের আগে চট্টগ্রাম বন্দরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অবস্থান, তাদের গতিবিধি, বন্দরে থাকা জাহাজের সংখ্যা, বয়রাগুলোর অবস্থান সম্পর্কে জানা এবং কর্ণফুলীর টাইটাল চার্ট সংগ্রহ করা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তখন এটি ছিল অত্যন্ত দুরূহ একটি কাজ। কাজটি মো. শাহ আলম দক্ষতার সঙ্গে করেন।
১৫ আগস্ট মধ্যরাতে (ঘড়ির কাঁটা অনুসারে তখন ১৬ আগস্ট) নৌ-কমান্ডোরা সাফল্যের সঙ্গে অপারেশন শেষ করেন। এতে ১০টি টার্গেট সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস বা নিমজ্জিত হয়। এগুলো ছিল জাহাজ, গানবোট, বার্জ ও পন্টুন। চট্টগ্রাম বন্দরে পরিচালিত ভয়াবহ অপারেশনটির খবর সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রচারমাধ্যম এ ঘটনা ফলাও করে প্রচার করে।
মো. শাহ আলম ১৯৭১ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এতে যোগ দেন। পরে ভারতে গিয়ে নৌ-কমান্ডো বাহিনীতে যোগ দেন।
তিনি বসবাস করতেন চট্টগ্রাম মহানগরে। স্বাধীনতার পর এমবিবিএস পাস করে চিকিত্সা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন।
সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, প্রথম খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১২
সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান