বিজ্ঞাপন
default-image

কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের রাতে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ঘাঁটির কাছাকাছি পরিখা খনন করে অবস্থান নেন। কয়েকটি দল ও উপদলে বিভক্ত ছিলেন তাঁরা। তাঁদের সার্বিক নেতৃত্বে ছিলেন মেজর আবু তাহের (বীর উত্তম, পরে লেফটেন্যান্ট কর্নেল)। তাঁর সঙ্গে থাকা উপদলে ছিলেন মো. এজাজুল হক খান।

মধ্যরাতে শুরু হয়ে যায় তুমুল যুদ্ধ। বারুদের উত্কট গন্ধ, গোলাগুলিতে প্রকম্পিত হয় চারদিক। একপর্যায়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পাল্টা আক্রমণের তীব্রতা বেড়ে যায়।

সকালের দিকে যুদ্ধের তীব্রতা কমে যায়। এ সময় অগ্রভাগে থাকা মুক্তিযোদ্ধা দলের দলনেতা অধিনায়ক আবু তাহেরকে জানান, তাঁরা পাকিস্তানি দুর্গের প্রায় ভেতরে ঢুকে পড়েছেন। আবু তাহের বিজয় প্রায় হাতের মুঠোয় ভেবে মো. এজাজুল হক খানদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। একটু পর তিনি নিজেও সামনে এগিয়ে যান।

তখন আনুমানিক সকাল নয়টা। এ সময় হঠাত্ পাকিস্তানি সেনাদের ছোড়া একটি শেল পড়ে আবু তাহেরের সামনে। বিস্ফোরিত শেলের স্প্লিন্টার লাগে তাঁর পায়ে। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। তাঁর সঙ্গে ছিলেন তিন-চারজন মুক্তিযোদ্ধা। তাঁরা বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। মো. এজাজুল হক খান ছিলেন সামনে কিছুটা এগিয়ে। তিনি দ্রুত এসে কয়েকজনের সহায়তায় আবু তাহেরকে উদ্ধার করে দ্রুত নিরাপদ স্থানে নিয়ে যান।

এ ঘটনা ১৯৭১ সালের ১৪-১৫ নভেম্বরের। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কামালপুর বিওপিতে। জামালপুর জেলার বকশীগঞ্জ উপজেলার অন্তর্গত কামালপুর গ্রামের মাঝামাঝি বিওপির অবস্থান। এখানে ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর শক্ত ঘাঁটি। কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা ছিল গোটা বিওপি। মূল প্রতিরক্ষার চারপাশে ছিল অনেক বাংকার। মুক্তিযুদ্ধকালে এখানে অসংখ্য যুদ্ধ সংঘটিত হয়।

সেদিন অগ্রবর্তী দলের মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দুর্ভেদ্য ওই প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে মূল প্রতিরক্ষায় ঢুকে যান। অনেক মুক্তিযোদ্ধা মাইন ও গুলির আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তার পরও তাঁরা থেমে যাননি। দেশমাতৃকার প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসায় এগিয়ে যান। অবশ্য বিজয়ী হতে পারেননি।

মো. এজাজুল হক খান পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ৩ কমান্ডো ব্যাটালিয়নে চাকরি করতেন। ১৯৭১ সালে এর অবস্থান ছিল কুমিল্লা সেনানিবাসে। ২৫ মার্চের পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে তিনি বন্দী হন। পাকিস্তানিরা তাঁকে নির্যাতন করে, তবে হত্যা করেনি। জুলাই মাসের শেষে সেনা কর্তৃপক্ষ অঙ্গীকারনামা নিয়ে তাঁকে মুক্তি দেয় এবং চাকরিতে পুনর্বহাল করে।

কয়েক দিন পর তিনি মা-বাবার সঙ্গে দেখা করার কথা বলে ছুটি নিয়ে বাড়িতে যান। তারপর পালিয়ে ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। ১১ নম্বর সেক্টরের মহেন্দ্রগঞ্জ সাবসেক্টর এলাকায় কামালপুরসহ বিভিন্ন স্থানে সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করেন।

সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, দ্বিতীয় খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১৩

সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান