১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর মুহাম্মদ আইনউদ্দিন প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে ২ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেন। মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা শোনা যাক তাঁর বয়ানে (১৯৭৩):
‘মনতলা ক্যাম্প থেকে দুই কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে আমি সোনামুড়া [ভারত] গেলাম। ২৩ নভেম্বর সোনামুড়ায় যে ভারতীয় সেনারা প্রতিরক্ষা নিয়েছিল, তাদের কাছ থেকে আমি দায়িত্ব বুঝে নিয়ে বাংলাদেশের দিকে অগ্রসর হই। বাংলাদেশের ভেতরে আরও দুটি দল [দুই কোম্পানি] আগে থেকেই অবস্থান করছিল। আমাকে নির্ভয়পুর [ভারত] যেতে এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কুমিল্লা দখল করতে বলা হলো। সেখানে যাওয়ার পর ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার টম পান্ডে আমাকে কুমিল্লা-চট্টগ্রাম রাস্তার মাঝে চিওড়ায় প্রতিরক্ষা অবস্থান নিতে বললেন।
‘৩ ডিসেম্বর চিওড়া গেলাম। পৌঁছানোর পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কোনো রকম প্রতিরোধ না করে পেছনের দিকে চলে গেল। তারা চিওড়া বাজারের উত্তর দিকে ডিফেন্স নিয়েছিল। ৫ ডিসেম্বর সকালে বালুতুফা (কুমিল্লা শহরের পূর্ব পাশে) গিয়ে আমি মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকি। আমরা বালুতুফায় যেখানে পৌঁছাই, সেখান থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ডিফেন্স ছিল কয়েক মাইল দূরে। সেখানে ছিল পাকা বাংকার। আমি ভাবলাম, পাকিস্তানি সেনারা পাকা বাংকারে ডিফেন্স নিয়ে আছে। অল্পসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে তাদের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধ করা সম্ভব নয়।
‘এরপর পাকিস্তানি সেনাদের পেছন দিয়ে আমরা ৬ ডিসেম্বর কুমিল্লা শহরে প্রবেশ করি।
‘ওই দিনই আমরা কুমিল্লা সেনানিবাসে দক্ষিণ দিক থেকে আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কিন্তু পরে ভারতীয় হাইকমান্ড থেকে আমাদের জানানো হয়, সেনানিবাস আক্রমণ করতে হবে না। এ নির্দেশের পর আমি সেনানিবাস আক্রমণের পরিকল্পনা বন্ধ করি। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনারা যখন আত্মসমর্পণ করে, তখন আমি সেনানিবাসে উপস্থিত ছিলাম।’
মুহাম্মদ আইনউদ্দিন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলে চাকরি করতেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের সাত দিন আগে থেকে বদলির কারণে ছুটিতে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে যুদ্ধে যোগ দেন।
প্রতিরোধযুদ্ধে মুহাম্মদ আইনউদ্দিনের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এ সময় তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অ্যান্ডারসন খাল সেতুসংলগ্ন স্থানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। ২৯ মার্চ দুপুরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি কনভয় খালের কাছে পৌঁছালে তিনি সহযোদ্ধাদের নিয়ে সাহসের সঙ্গে আক্রমণ করেন। এতে পাকিস্তানিদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ভারতে পুনরায় সংগঠিত হওয়ার পর তিনি প্রথমে ২ নম্বর সেক্টরে সাবসেক্টর অধিনায়ক হিসেবে, পরে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর কে ফোর্সের অধীনে যুদ্ধ করেন। নবম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, দ্বিতীয় খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১৩
সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান