বিজ্ঞাপন
default-image

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর প্রতিরোধযুদ্ধকালে মুন্সী আব্দুুর রউফসহ একদল মুক্তিযোদ্ধা প্রতিরক্ষা অবস্থান নিয়েছিলেন বুড়িঘাটে। রাঙামাটি জেলার নান্নেরচরের অন্তর্গত বুড়িঘাট। রাঙামাটি-খাগড়াছড়ি সড়ক বুড়িঘাট হয়ে চট্টগ্রামের সঙ্গে সংযুক্ত। কালুরঘাট থেকে রামগড়ে যাওয়ার একমাত্র পথ ছিল বুড়িঘাট দিয়ে। এ ছাড়া আর কোনো বিকল্প পথ তখন ছিল না। কালুরঘাটের পতন হলে পাকিস্তানিরা বুড়িঘাট ও রামগড় দখলের জন্য তত্পর হয়ে ওঠে।

১৮ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর শক্তিশালী কমান্ডো ব্যাটালিয়নের একটি দল বুড়িঘাটে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানে আক্রমণ করে। সাতটি স্পিডবোট ও দুটি লঞ্চযোগে তারা সেখানে আসে। সংখ্যায় ছিল দুই কোম্পানির মতো। ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত। ভারী অস্ত্রের মধ্যে ছিল ছয়টি তিন ইঞ্চি মর্টার ও অসংখ্য মেশিনগান।

পাকিস্তানিদের তুলনায় মুক্তিযোদ্ধারা সংখ্যায় কম ছিলেন। তার পরও তাঁরা অসীম মনোবল ও দৃপ্ত প্রত্যয় নিয়ে যুদ্ধ করেন। কিন্তু পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর শত শত তিন ইঞ্চি মর্টারের গোলা আর মেশিনগানের হাজার হাজার গুলিতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা অবস্থানে বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়।

এই পরিস্থিতির সুযোগে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কমান্ডো দল তীরে নেমে মুক্তিযোদ্ধাদের তিন দিক থেকে ঘেরাও করে ফেলে। পাকিস্তানিদের অব্যাহত গোলাগুলির মুখে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয় যে সেখানে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধারা সবাই জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে পড়েন। এ অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধাদের পশ্চাদপসরণ করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন কাভারিং ফায়ার। অসীম সাহসী মুন্সী আব্দুর রউফ স্বেচ্ছায় এ দায়িত্ব নিজের কাঁধে নেন। দলনেতা খালেকুজ্জামানকে তিনি বলেন, ‘স্যার, আপনি সবাইকে নিয়ে পশ্চাদপসরণ করুন। আমি পাকিস্তানিদের মোকাবিলা করছি।’

এরপর মুন্সী আব্দুর রউফ একাই পাকিস্তানিদের মোকাবিলা করতে থাকেন। এই সুযোগে তাঁর সহযোদ্ধারা নিরাপদে পশ্চাদপসরণ করেন। রউফের অস্ত্রের নিখুঁত গুলিবর্ষণে পাকিস্তানিদের কয়েকটি স্পিডবোট ডুবে যায়। বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়।

আকস্মিক ক্ষতিতে পাকিস্তানিদের মনোবল দুর্বল হয়ে পড়ে। তারা নিরাপদ দূরত্বে পিছু হটে যায়। পেছনে পাকিস্তানি বাহিনী পুনর্গঠিত হয়ে মুন্সী আব্দুর রউফের অবস্থান লক্ষ্য করে আবারও মর্টারের গোলা বর্ষণ করতে থাকে। একটা গোলা সরাসরি রউফের দেহে আঘাত করে। ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় তাঁর দেহ। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে মাংসপিণ্ড। পরে সহযোদ্ধারা রউফের দেহের খণ্ডিত অংশ সংগ্রহ ও একত্র করেন। সেখানে একটি টিলার ওপর তাঁকে সমাহিত করা হয়।

মুন্সী আব্দুর রউফ ইপিআর বাহিনীতে চাকরি করতেন। ১৯৭১ সালে চট্টগ্রাম সেক্টরের অধীন ১১ নম্বর উইংয়ে কর্মরত ছিলেন। মাঝারি মেশিনগান ডিটাচমেন্টের ১ নম্বর মেশিনগানচালক ছিলেন তিনি।

সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, দ্বিতীয় খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১৩

সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান