মধ্যরাতে মঞ্জুর আহমেদ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অবস্থানের কাছাকাছি তাঁর সহযোদ্ধাদের নিয়ে অবস্থান নেন। রাত শেষ হয়ে আসছে। এ সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাঁদের ওপর আকস্মিকভাবে হামলা করে। মুক্তিযোদ্ধারা প্রথমে কিছুটা বিপর্যস্ত হয়ে পড়লেও মঞ্জুর আহমেদের প্রচেষ্টায় দ্রুত সংগঠিত হয়ে পাল্টা আক্রমণ চালান। শুরু হয় প্রচণ্ড যুদ্ধ। দুপুরের পর পাকিস্তানি আক্রমণের তীব্রতা আরও বেড়ে যায়। মঞ্জুর আহমেদ এতে বিচলিত না হয়ে তাঁর দলের নেতৃত্ব দিয়ে চললেন। মুক্তিযোদ্ধাদেরও মনোবল বেড়ে গেল। এ ঘটনা ১৯৭১ সালের ২৪ অক্টোবরে ঘটেছিল গোয়াইনঘাটে।
গোয়াইনঘাট সিলেট জেলার অন্তর্গত। ১৯৭১ সালে সেখানে ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর শক্ত এক প্রতিরক্ষা অবস্থান। সুরমা নদী গোয়াইনঘাট উপজেলাকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছে। ছাতক অপারেশনের পর নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট গোয়াইনঘাট আক্রমণের জন্য সমবেত হয় ৫ নম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টারে (ভোলাগঞ্জ)। লেংগুরা গ্রামের দক্ষিণে ব্রিজহেড তৈরির মাধ্যমে নদী অতিক্রম করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পূর্ব পারের প্রতিরক্ষা অবস্থানে আক্রমণ পরিচালনার দায়িত্বে থাকে আলফা কোম্পানি। ওই কোম্পানির নেতৃত্বে ছিলেন মঞ্জুর আহমেদ।
পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী তাঁরা ২৩ অক্টোবর রাতে সেখানে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেন। কিন্তু স্থানীয় সহযোগীদের মাধ্যমে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাঁদের উপস্থিতি টের পায়। ২৪ অক্টোবর ভোর আনুমানিক সাড়ে পাঁচটার দিকে আকস্মিকভাবে তারা আক্রমণ চালায়। সে সময় মুক্তিযোদ্ধারা পরিখা খনন করে প্রতিরক্ষা অবস্থান তৈরি করছিলেন। মুক্তিযোদ্ধারা এতে কিছুটা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। এ সময় মঞ্জুর আহমেদ নেতৃত্ব দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের পুনরায় সংগঠিত করে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর পাল্টা আক্রমণ চালান। দুপুরের পর হেলিকপ্টারযোগে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি নতুন দল এসে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করে। সন্ধ্যা পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের পাল্টাপাল্টি আক্রমণ চলে। পুরো গোয়াইনঘাট এলাকা রক্তক্ষয়ী রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। কোনো কোনো জায়গায় দুই পক্ষের মধ্যে হাতাহাতি যুদ্ধও হয়। পাকিস্তানি সেনাদের ফায়ার পাওয়ার এতই বেশি ছিল যে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে কোনো একটি অবস্থানেও টিকে থাকা সম্ভব ছিল না। তার পরও তাঁরা যুদ্ধ চালিয়ে যান।
মঞ্জুর আহমেদ ১৯৭০-৭১ সালে পাকিস্তানি বিমানবাহিনীতে যোগদানের অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি এতে যোগ দিয়ে প্রথমে ২ নম্বর সেক্টরের অধীনে যুদ্ধ করেন। মে মাসে মুহুরী নদীর একটি সেতু ধ্বংসে তিনি অংশ নেন। এরপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সম্পর্কে খবর সংগ্রহের জন্য চট্টগ্রামে যান। জুনে তাঁকে প্রথম বাংলাদেশ ওয়ার কোর্সে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। প্রশিক্ষণ শেষে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধীনে ছাতক, রাধানগর ও গোয়াইনঘাট আক্রমণে অংশ নেন।
সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, প্রথম খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১২
সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান