বিজ্ঞাপন
default-image

সিলেট সদর উপজেলার কুচাই ইস্রাব আলী উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্র নীলমণি বিশ্বাস ১৯৭১ সালে এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন। পরীক্ষার আগেই শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সিলেটে সংখ্যালঘু হিন্দুদের বেছে বেছে হত্যা শুরু করলে বেশির ভাগ হিন্দু পরিবার ভারতে চলে যায়। নীলমণির আত্মীয়স্বজন সবাই চলে গেলেও কয়েকটি পরিবার থেকে যায়। চৈত্রের শেষ দিকে (এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ) একদিন কিশোর নীলমণিদের গ্রামে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি দল কয়েকজন সংখ্যালঘুকে হত্যা করে। সেদিন নীলমণি ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা পালিয়ে প্রাণ বাঁচান। এরপর তাঁদের পরিবার ভারতে চলে যায়। সেখানে নীলমণি মুক্তিবাহিনীতে নাম লেখান। প্রথমে তাঁকে মুক্তিবাহিনীতে নেওয়া হয়নি। অনেক অনুনয়-বিনয়ের পর তাঁকে তাতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ভারতের শিলচরের ধালচরা ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর নীলমণি যুদ্ধ করেন ৪ নম্বর সেক্টরের অমলসিদ সাব-সেক্টরের অধীনে। এই সাব-সেক্টরের অধীনে ছিল কানাইঘাট ও পার্শ্ববর্তী এলাকা। এ অঞ্চলে ছিল সুরমা নদীসহ কয়েকটি ছোট নদী এবং অসংখ্য খাল-বিল ও ছোট ছোট পাহাড়। প্রাকৃতিক এসব প্রতিবন্ধকতার সুযোগ নিয়ে মুক্তিবাহিনীর স্বল্প প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা আকস্মিক আক্রমণ চালিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ব্যাপক ক্ষতি সাধনে সক্ষম হন।

নীলমণি বেশ কয়েকটি অপারেশনে অংশ নেন। এর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে কানাইঘাটের যুদ্ধ অন্যতম। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে স্মরণীয় ও উল্লেখযোগ্য কানাইঘাটের যুদ্ধ। কানাইঘাট সিলেট জেলার অন্তর্গত উপজেলা। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সিলেট অভিমুখী অগ্রাভিযানের জন্য কানাইঘাট মুক্ত করা ছিল জরুরি; কানাইঘাটে পাকিস্তানি সেনারা তখন শক্ত প্রতিরক্ষা অবস্থান তৈরি করে। মুক্তিবাহিনীর কয়েকটি দল আক্রমণ চালায় কানাইঘাটে। মূল পরিকল্পনা অনুযায়ী লেফটেন্যান্ট গিয়াস ও লেফটেন্যান্ট জহিরের নেতৃত্বে দুই কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা দরবস্ত-কানাইঘাট ও চরঘাট-কানাইঘাট সড়কের ওপর অর্থাত্ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার জন্য অগ্রসর হন। নীলমণি ছিলেন লেফটেন্যান্ট জহিরের নেতৃত্বাধীন দলে। এ দলের বেশির ভাগ মুক্তিযোদ্ধাই ছিলেন স্বল্প প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তাঁরা অগ্রসর হওয়ার পথে পাকিস্তানি সেনাদের আকস্মিক আক্রমণের মুখে পড়েন। প্রচণ্ড গোলাগুলির কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রযাত্রা স্থবির হয়ে পড়ে এবং সেখানে প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু হয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গুলিতে শহীদ ও আহত হন বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধের একপর্যায়ে বাংকারে থাকা নীলমণি মাথা তুলে পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থানে গ্রেনেড নিক্ষেপ করার চেষ্টা করতে গেলে গুলি এসে লাগে তাঁর মাথায়। শহীদ হন কিশোর নীলমণি। পরে তাঁর মরদেহ সমাহিত করা হয় কানাইঘাটেই।

সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, প্রথম খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১২

সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান