বিজ্ঞাপন
default-image

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর দীর্ঘ ২৫ বছর লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিলেন তারামন বিবি। তাঁর নাম ছিল শুধু গেজেটের পাতায়। ১৯৯৫ সালে প্রচারের আলোয় আসেন। তারামন বিবি মুক্তিবাহিনীর ১১ নম্বর সেক্টরের একটি দলের সঙ্গে ছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধকালের ঘটনা তাঁর জবানিতেই জানা যাক: ‘আমাদের বাড়ি ছিল রাজীবপুরের আলেকচর শংকর-মাধবপুর ইউনিয়নে। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স ১৪। সে সময় দেশে শুরু হলো তোলপাড়। শয়ে শয়ে মানুষ পালিয়ে যাচ্ছে। কে কোথায় যাচ্ছে জানি না। আমরাও পালিয়ে যাই কোদালকাঠিতে।

‘একদিন, দিন-তারিখ মনে নাই, জঙ্গলে কচুর মুখি তুলছিলাম। একজন বয়স্ক মানুষ (মুহিফ হালদার), আমাকে বললেন, “তুমি আমাদের ক্যাম্পে কাজ করবা। ভাত রাইন্ধা দিবা। কী, পারবা না মা?” সেদিন কোথা থেকে যেন একটা শক্তি পেলাম। মনে হলো, এই তো সুযোগ। মাথার ওপর রক্ষা করার মতো কেউ নাই, যার ভরসায় বেঁচে থাকব। মরতে তো হবেই। যুদ্ধ করে বাঁচার চেষ্টা করলে দোষের কী।

‘তাঁকে বললাম, আফনে আমার মায়ের লগে কথা কন। উনি যাইবার দিলে যাইমু। সেই সন্ধ্যায় তিনি আমার মার কাছে যান। শুধু বিশ্বাসের ওপর আমার মা আমাকে তাঁর সাথে দেন।

‘কোদালকাঠিতেই আমার প্রথম ক্যাম্পজীবন শুরু। রান্না করা, ডেক ধোয়া। অস্ত্র পরিষ্কার করা। একদিন আজিজ মাস্টার বললেন, পাকিস্তানি ক্যাম্পের খবর আনতে হবে। কোনো পুরুষ যেতে পারবে না। যেতে হবে আমাকে। তা-ও নদী (নদ) পার হয়ে। কথাগুলো শুইনাই কইলজাটা চিনচিন করে উঠল। রাজি হয়ে গেলাম, যা থাকে কপালে! পাগলির বেশে, ছেঁড়া কাপড় পরে যেতাম শত্রুর ক্যাম্পে।

‘শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে অস্ত্র চালানো শিখলাম। একদিন দুপুরবেলা। ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছে। ক্যাম্পের আমরা সবাই ভাত খাচ্ছিলাম। এ সময় আজিজ মাস্টার আমাকে পিছলা গাছে উঠতে বললেন। গাছে উঠে দুরবিন দিয়ে নদীর দিকে দেখতেই চোখ বড় হয়ে গেল। নদীতে গানবোট। কিসের আর ভাত খাওয়া। সেদিন বৃষ্টির মতো গুলি সন্ধ্যা পর্যন্ত। আমি কখন যে স্টেনগান নিয়ে গুলি করতে শুরু করেছি খেয়াল করিনি। কনুই আর পায়ের পাতার ওপর ভর দিয়া কত জায়গা যে পার হয়্যা গেছি। রক্ত বের হয়্যা গেছিল।

‘স্বাধীনতার পর শুরু হলো আরেক জীবন। আম্মা-ভাইবোনদের খুঁজে পেলাম। থাকার জায়গা নাই। খাবার নাই। চরে আমরা ঘর বাঁধলাম। কাজ নিলাম মানুষের বাড়িতে। চরেই শুরু হলো আমাদের জীবন। চর ভাঙে, আমাদের ঘর ভাঙে। আবার ঘর বানাই। এভাবেই চলে যায় চব্বিশটা বছর।’

সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, দ্বিতীয় খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১৩

সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান