খিজির আলী যুদ্ধ করেন ৯ নম্বর সেক্টরের হিঙ্গলগঞ্জ সাব-সেক্টর এলাকায়। ১৯৭১ সালে ছিলেন মেকানিক। তখন তাঁর বয়স ৩৭ বছর। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে যুদ্ধে যোগ দেন।
খিজির আলীর অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ ছিল না। তার পরও ২৬ মার্চ খুলনা মহানগরের বৈকালি এলাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অগ্রযাত্রা সামান্য বন্দুক দিয়ে তিনি অনেকক্ষণ ঠেকিয়ে রাখেন। খুলনার পতন হলে তিনি ভারতে যান। সেখানে কয়েক দিন প্রাথমিক প্রশিক্ষণ নিয়ে সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার টাউন শ্রীপুরে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে সফল অপারেশন করেন। তাঁরা ৩১ জন মুক্তিযোদ্ধা একযোগে গ্রেনেড নিক্ষেপ করলে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। পূর্ণাঙ্গ প্রশিক্ষণ শেষে প্রথম অংশ নেন অপারেশন জ্যাকপটে। ১৫ আগস্ট মধ্যরাতে একদল নৌ-কমান্ডো মংলা বন্দরে লিমপেট মাইনের সাহায্যে কয়েকটি জাহাজ ডুবিয়ে দেয়। খিজির আলীর দলের ওপর দায়িত্ব ছিল নৌ-কমান্ডোদের অবস্থানস্থলে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা ও তাঁদের গাইড হিসেবে কাজ করা। তাঁদের রেকি করা তথ্যের ভিত্তিতেই নৌ-কমান্ডোরা সফলতার সঙ্গে অপারেশন করেন। পরে আরও কয়েকটি অপারেশনে তিনি নৌ-কমান্ডোদের সঙ্গে অংশ নেন। এর মধ্যে আশাশুনি থানা দখলের অভিযান উল্লেখযোগ্য।
আশাশুনি সাতক্ষীরার অন্তর্গত। জেলা সদর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দক্ষিণে। আশাশুনিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি ঘাঁটি ছিল। তাদের সঙ্গে ছিল বিপুলসংখ্যক রাজাকার। অক্টোবরের মাঝামাঝি মুক্তিযোদ্ধা ও নৌ-কমান্ডোরা যৌথভাবে সেখানে আক্রমণ করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দলের নেতৃত্ব দেন খিজির আলী। দুই দিন সেখানে যুদ্ধ চলে। প্রথম দিন সারা রাত যুদ্ধ হয়। পরদিন মুক্তিযোদ্ধারা পুনর্গঠিত হয়ে আবার পরিকল্পিতভাবে আক্রমণ চালান। এদিন তাঁরা পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের ফাঁকি দিয়ে থানার ঘাটে ভাসমান ফেরি পন্টুনে কয়েকটি মাইন লাগান। মাইন বিস্ফোরণে গোটা ফেরিঘাট তছনছ হয়ে যায়। লোহার পাত বিভিন্ন দিকে ছিটকে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের মধ্যে তীব্র ভীতি সৃষ্টি হয়। এ সময় দুঃসাহসী খিজির আলী দুই হাতে দুটি এলএমজি নিয়ে ঝড়ের বেগে গুলি করতে করতে থানার ভেতরে ঢুকে পড়েন। এ দৃশ্য দেখে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা বিস্মিত ও হতভম্ব হয়ে পড়ে। তাঁর ভয়াল রণমূর্তি দেখে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা এতই ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে যে তারা নিজেদের অস্ত্রশস্ত্র ফেলেই পালাতে থাকে। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা সহজেই আশাশুনি থানা দখল করে নেন। ১১ জন পাকিস্তানি সেনা ও ৪০ জন রাজাকার তাঁদের হাতে নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা অবশ্য বেশিক্ষণ আশাশুনি থানার দখল ধরে রাখতে পারেননি। পরদিন পাকিস্তানি হেলিকপ্টার বৃষ্টির মতো গুলি ও বোমা ফেলতে থাকে। তখন মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে যান।
সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, প্রথম খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১২
সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান