আবদুস সালেক চৌধুরী নির্ধারিত সময়ে সংকেত দেওয়ামাত্র গর্জে উঠল মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র। তাঁর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা বীর বিক্রমে যুদ্ধ করতে থাকেন। একপর্যায়ে ভীতসন্ত্রস্ত পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটতে শুরু করে। ঠিক তখনই মুক্তিযোদ্ধারা চরম এক সংকটের মুখোমুখি হন। শেষ হয়ে যায় মুক্তিযোদ্ধাদের গোলাবারুদ। এ ঘটনা নয়নপুরে ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষে।
নয়নপুর ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অন্তর্গত। সালদা নদী রেলস্টেশনের কাছে। ১৯৭১ সালে সালদা নদী, নয়নপুরসহ আশপাশের গোটা এলাকায় ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থান। সেপ্টেম্বর মাসে পাকিস্তানি সেনারা তাদের এই প্রতিরক্ষা অবস্থান আরও মজবুত করে। ঠিক এই অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধারা তাদের অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। ফলে বেধে যায় ভয়াবহ যুদ্ধ। মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দলের নেতৃত্ব দেন আবদুস সালেক চৌধুরী। এ যুদ্ধের বিবরণ পাওয়া যায় মুক্তিযোদ্ধা উইং কমান্ডার (অব.) কামালউদ্দিন আহমেদের লেখা থেকে। তিনি লিখেছেন, ‘আমরা প্রায় প্রতিরাতে সালদা নদীতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ডিফেন্স পজিশনে রেইড দিতাম। তারা (পাকিস্তানি) থাকত সুদৃঢ় ব্যাংকারে এবং উন্নতমানের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে। প্রতিটি রেইডেই কমবেশি ক্যাজুয়ালিটি হতো। একদিন মেজর সালেক, ক্যাপ্টেন গাফফার ও আমি চিন্তা করলাম ওদেরকে ঘেরাও করে সারেন্ডার করানো যায় কি না। এটা ছিল বড় রকমের আক্রমণের পরিকল্পনা।
‘ঠিক ভোর পাঁচটায় ইন্ডিয়ান আর্মির আর্টিলারি সাপোর্ট নিয়ে মেজর সালেক ও ক্যাপ্টেন গাফফার শত্রুর রিয়ার দিয়ে আক্রমণ শুরু করলেন। গোলাগুলির প্রচণ্ডতায় আমি নিশ্চিত ছিলাম, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কোম্পানি সারেন্ডার করতে বাধ্য হবে। আমি আমার ভান্ডারের সব গোলাবারুদ উজাড় করে দিলাম শত্রুর ওপর। এ ব্যাপারটি ছিল খুবই বিপজ্জনক। কারণ, আমার ও শত্রু অবস্থানের মধ্যে কোনো ব্যারিয়ার ছিল না। ঠিক তখনই মেজর সালেক ও ক্যাপ্টেন গাফফারের এলাকা থেকে গুলির আওয়াজ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসছিল। এটা ছিল শত্রুর বিরুদ্ধে আমাদের প্রথম সরাসরি আক্রমণ।’
আবদুস সালেক চৌধুরী ১৯৭১ সালে চাকরি করতেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে। কর্মরত ছিলেন ঢাকা সেনানিবাসে। তখন তাঁর পদবি ছিল ক্যাপ্টেন। মার্চ মাসে ঢাকায় ছিলেন। ২২ এপ্রিল পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। প্রাথমিক পর্যায়ে মেজর খালেদ মোশাররফের (বীর উত্তম, পরে মেজর জেনারেল) অধীনে কুমিল্লা অঞ্চলে যুদ্ধ করেন। পরে সেক্টর গঠিত হলে দুই নম্বর সেক্টরের সালদা নদী সাবসেক্টরের অধিনায়ক নিযুক্ত হন। অক্টোবর মাসে মেজর খালেদ মোশাররফ আহত হলে নিয়মিত মুক্তিবাহিনী কে ফোর্সের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, দ্বিতীয় খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১৩
সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান