বিজ্ঞাপন
default-image

চারদিকে নিকষ অন্ধকার। মুষলধারে বৃষ্টিও হচ্ছে। খালি চোখে কিছুই দেখা যায় না। চরম প্রতিকূল পরিবেশ। এর মধ্যেই ভারত থেকে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে ঢুকলেন আবদুল হকসহ একদল মুক্তিযোদ্ধা। অদূরেই আধা পাকা রাস্তা। সেই রাস্তায় তাঁরা দ্রুত মাইন স্থাপন করলেন। এরপর তাঁরা অবস্থান নিলেন সেই রাস্তারই আশপাশে। ভোরে সেখানে এল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সেনাভর্তি লরি। মাইন বিস্ফোরণের পাশাপাশি একই সঙ্গে গর্জে উঠল তাঁদের অস্ত্র। ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯৭১ সালের ৩১ জুলাই, উঠানীপাড়ায়।

জামালপুরের বকশীগঞ্জ উপজেলার অন্তর্গত কামালপুরে ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর শক্তিশালী একটি প্রতিরক্ষা অবস্থান। ৩০ জুলাই ভোরে (তখন ঘড়ির কাঁটা অনুসারে ৩১ জুলাই) মুক্তিবাহিনী সেখানে আক্রমণ করে। এই আক্রমণে কাট অফ পার্টি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে মুক্তিবাহিনীর অপর একটি দল। এ দলে ছিলেন আবদুল হক।

আক্রমণের নির্ধারিত সময় ছিল রাত তিনটা ৩০ মিনিট। সন্ধ্যার পর মুক্তিযোদ্ধারা উঠানীপাড়ার উদ্দেশে যাত্রা করেন। সেদিন হঠাৎ শুরু হয় মুষলধারে বৃষ্টি। বৃষ্টি ও ঘোর অন্ধকার উপেক্ষা করে আবদুল হকসহ একদল মুক্তিযোদ্ধা (নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি কোম্পানি) ক্যাপ্টেন মাহবুবের নেতৃত্বে সময়মতোই সীমান্ত অতিক্রম করেন। তাঁরা অবস্থান নেন কামালপুর-বকশীগঞ্জ সড়কের কামালপুরের এক মাইল দক্ষিণে কামালপুর-শ্রীবরদী সড়কের সংযোগস্থল ও উঠানীপাড়ায়। কামালপুর বিওপিতে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের সংবাদ শুনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বকশীগঞ্জ কোম্পানি হেডকোয়ার্টার থেকে সেনাভর্তি তিনটি লরি কামালপুরের উদ্দেশে যাত্রা করে। লরিগুলো ভোররাত সাড়ে চারটা বা পাঁচটার দিকে সেখানে উপস্থিত হয়। উঠানীপাড়া এলাকার সড়কে স্থাপন করা মাইন বিস্ফোরণে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দুটি লরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আবদুল হক ও তাঁর সহযোদ্ধারা সঙ্গে সঙ্গে তাদের ওপর আক্রমণ শুরু করেন। এতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ওই দলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি (আটজন নিহত ও ১০-১১ জন আহত) হয়। মুক্তিবাহিনীর একজন শহীদ ও দু-তিনজন আহত হন। যুদ্ধ শেষে মুক্তিযোদ্ধারা পশ্চাদপসরণ করে সীমান্ত এলাকায় চলে যান।

আবদুল হক চাকরি করতেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। ১৯৭১ সালের মার্চ-এপ্রিলে এই ব্যাটালিয়নের পশ্চিম পাকিস্তানে (বর্তমানে পাকিস্তান) বদলি হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। এর আগে ফেব্রুয়ারির মধ্যভাগ থেকে ইউনিটের অর্ধেক সেনা ছুটিতে এবং বাকি সবাই শীতকালীন প্রশিক্ষণে ছিলেন। আবদুল হকও সে সময় ছুটিতে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি যুদ্ধে যোগ দেন। নিজ এলাকায় প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নেওয়ার পর তিনি ভারতে গিয়ে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দেন। কামালপুর যুদ্ধের পর জেড ফোর্সের অধীনে কুড়িগ্রাম জেলার কোদালকাটিসহ আরও কয়েকটি যুদ্ধে তিনি অংশ নেন। কোদালকাটির যুদ্ধে তিনি আহত হন। তাঁর পায়ে গুলি লাগে। সুস্থ হওয়ার পর তিনি আবার যুদ্ধে যোগ দেন।

সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, প্রথম খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১২

সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান