বিজ্ঞাপন
default-image

মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়। প্রায় দেড় মাস ধরে যুদ্ধ-উন্মাদনার মধ্যে আছেন আবদুল লতিফ মজুমদার ও তাঁর সহযোদ্ধারা। অক্টোবর মাসের শেষ দিক থেকে বৃহত্তর সিলেট জেলার বিভিন্ন জায়গায় একের পর এক যুদ্ধ করেছেন। তার পরও তাঁদের যুদ্ধ করার আগ্রহে ভাটা পড়েনি, বরং আরও বেড়েছে।

কানাইঘাট থেকে তাঁরা রওনা হন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সিলেট শহরের প্রতিরক্ষা অবস্থান অভিমুখে। ১৪ ডিসেম্বর শেষ রাতে সেখানে পৌঁছালেন। একটু পরে সকাল হলো। শীতকাল। কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে খালি চোখেই পাকিস্তানি সেনাদের তত্পরতা তাঁদের চোখে পড়ে। আবদুল লতিফ ও তাঁর সহযোদ্ধারা তাদের ওপর আক্রমণ চালালেন।

১৯৭১ সালের ১৫-১৭ ডিসেম্বর সেখানে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধের বর্ণনা আছে আবদুল লতিফের দলনেতা (কোম্পানি কমান্ডার) লে. এম এ কাইয়ুম চৌধুরীর (পরে মেজর) ১৯৭৩ সালের বয়ানে। তিনি বলেন: ‘আমরা শত্রুঘাঁটির মধ্য দিয়ে অ্যাডভান্স টু কন্টাক্ট শুরু করি। কানাইঘাট থেকে বিকেলে সিলেট অভিমুখে যাত্রা শুরু করে পরদিন বিকেল পাঁচটার সময় আমরা কেওয়াচরা চা-বাগানে ডিফেন্স নিই। আমরা জানতাম, সিলেট শহরের উপকণ্ঠে এমসি কলেজকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বিরাট একটা দুর্গে পরিণত করেছে। রাতের বেলা একটা প্যাট্রোল দল পাঠানো হয়েছিল শত্রুর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করার জন্য।

‘সকালবেলা আমি আমার কোম্পানি নিয়ে সামনে অগ্রসর হচ্ছিলাম। কিন্তু শত্রু কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত হয়ে কতক্ষণ ডিফেন্সে থাকি। সেদিন সেখানে অবস্থান করার পর সন্ধ্যায় আমরা এমসি কলেজ অভিমুখে যাত্রা করি। পরদিন ভোর চারটার সময় এমসি কলেজের টিলার ওপর এসে আমরা শত্রুর গতিবিধি লক্ষ করছিলাম। শত্রু কিন্তু আমাদের উপস্থিতি সম্পর্কে একটুও সজাগ ছিল না। তারা ডিফেন্সের মধ্যে এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি করছিল।

‘যথেষ্ট পাঞ্জাবি সেনা একসঙ্গে দেখে নিজেকে আর দাবিয়ে রাখতে পারলাম না। পজিশন না নিয়েই ছয়টা মেশিনগান দিয়ে তিন দিক থেকে ফায়ার শুরু করলাম। শত্রুর মাথায় যেন বাজ ভেঙে পড়ল। ১৭ ডিসেম্বর বেলা ১১টা পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর যুদ্ধ চলে। তার পরই আসে আত্মসমর্পণের পালা। পাকিস্তানি সেনারা তাদের সমস্ত হাতিয়ার আমাদের কাছে সমর্পণ করে।’

আবদুল লতিফ মজুমদার চাকরি করতেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। এর অবস্থান ছিল যশোর সেনানিবাসে। তখন তাঁর পদবি ছিল নায়েব সুবেদার। ৩০ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বালুচ রেজিমেন্ট তাদের আক্রমণ করে। এ সময় তাঁরা যুদ্ধে যোগ দেন। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে প্রথমে ১১ নম্বর সেক্টরে, পরে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সের অধীনে যুদ্ধ করেন।

সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, দ্বিতীয় খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১৩

সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান