বিজ্ঞাপন
default-image

গভীর রাতে অ্যাসেম্বলি এরিয়া থেকে এফইউপিতে এলেন দুই কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা। তাঁরা কয়েকটি প্লাটুনে বিভক্ত। একটি প্লাটুনে আছেন শামসুজ্জামান। তিনি গণবাহিনীর সদস্য। তাঁরা সীমান্তে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর শক্তিশালী একটি ঘাঁটিতে আক্রমণ করবেন। মুক্তিবাহিনীর দুই কোম্পানিতে সেনাসদস্যের সংখ্যা মাত্র ২৪ থেকে ২৫। বাকি সবাই স্বল্প ট্রেনিংপ্রাপ্ত গণবাহিনীর সদস্য। তাঁরা মাত্র ২৮ দিনের ট্রেনিং নিয়েছেন। নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে তাঁদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

মুক্তিযোদ্ধা সবাই নিঃশব্দে ফায়ারবেসে অবস্থান নিয়েছেন। অধিনায়ক ক্যাপ্টেন আমীন আহম্মেদ চৌধুরী (বীর বিক্রম, পরে মেজর জেনারেল) আক্রমণের সংকেত দিলেন। শুরু হলো আর্টিলারি ফায়ার। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের লক্ষ্যের দিকে এগোতে লাগলেন। পাকিস্তানি সেনারাও বসে থাকল না। তাদের দিক থেকেও শুরু হলো পাল্টা আর্টিলারি ফায়ার। সীমান্তের ওই এলাকাজুড়ে যেন প্রলয় শুরু হয়ে গেল। গোলাগুলিতে গোটা এলাকা হলো প্রকম্পিত। এ ঘটনা ঘটে ১১ নম্বর সেক্টরের অধীন শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতী উপজেলার অন্তর্গত নকশী বিওপিতে ১৯৭১ সালের ৪ আগস্ট ভোরে।

প্রথাগত যুদ্ধক্ষেত্রে প্রচণ্ড গোলাগুলির মধ্যে সামনে অগ্রসর হওয়া দুঃসাহসিক কাজ। কখনো ক্রল করে, কখনো দৌড়ে সামনে এগোতে হয়। স্বল্প ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা পেশাদার সেনাদের মতো তা-ই করছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি প্লাটুন অত্যন্ত সাহস ও ক্ষিপ্রতার সঙ্গে গুলি করতে করতে পাকিস্তানি অবস্থানের প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে যায়। এর মধ্যে শামসুজ্জামানও ছিলেন। এ সময় তাঁদের ওপর এসে পড়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নিক্ষিপ্ত একটি আর্টিলারি গোলা। গোলার টুকরার আঘাতে বেশ কজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। দুই-তিনজনের দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। ঘটনার আকস্মিকতায় মুক্তিযোদ্ধারা কিছুটা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন। কিন্তু শামসুজ্জামানসহ কয়েকজন মনোবল হারালেন না। তাঁদের সাহসিকতা ও বীরত্বের মুখে পাকিস্তানি সেনারা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তারা পালিয়ে যেতে থাকে। রণক্ষেত্র নিহত ও আহত সেনাসদস্যে ভরে যায়। তাদের বেশির ভাগই পাকিস্তানি। শামসুজ্জামান তখন বিওপির ৫০ গজের মধ্যে পৌঁছে গেছেন। হঠাত্ একটি ভূমিমাইনের আঘাতে তিনি শহীদ হন। এ সময় আহত হন অধিনায়কসহ মুক্তিবাহিনীর আরও অনেকে। বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে এসেও মুক্তিযোদ্ধারা সেদিন সফল হতে পারেননি। শামসুজ্জামানসহ অনেকের লাশ সেদিন মুক্তিযোদ্ধারা উদ্ধার করতে পারেননি। যুদ্ধক্ষেত্র পাকিস্তানি সেনাদের অনুকূলে চলে যাওয়ায় তাঁদের পশ্চাদপসরণ করতে হয়।

শামসুজ্জামান ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগের অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য ভারতে যান। সেখানে তিনি ২৮ দিনের কঠোর প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ শেষে তাঁকে জেড ফোর্সের অধীন অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, প্রথম খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১২

সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান