ভোরের আলো ফোটার আগেই মুক্তিযুদ্ধের গণবাহিনীর একদল যোদ্ধা গোপন আস্তানা থেকে বেরিয়ে হাজির হলেন বালাসীঘাটে। তাঁদের নেতৃত্বে মাহাবুব এলাহী রঞ্জু। অদূরেই বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ। এর ঢালুতে উঁচু-নিচু যে জায়গা এবং জমিজমার যে উঁচু আইল, সেখানে গিয়ে তাঁরা দ্রুত অবস্থান নিলেন। কুয়াশায় ঢাকা চারদিকের চরাচর সূর্যের আলোয় ক্রমেই স্পষ্ট হতে লাগল। ঘড়ির কাঁটা দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। এ সময় পাকিস্তানি সেনাদের টহল দলকে—যেখানে তাঁরা অবস্থান নিয়েছিলেন—সেখান থেকে দেখা গেল। তারা নিশ্চিন্তে এগিয়ে আসছে। তারা কল্পনাও করেনি যে মুক্তিযোদ্ধাদের অ্যামবুুশে পড়বে। রঞ্জু ও তাঁর সহযোদ্ধারা নিঃশব্দে অপেক্ষা করছেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে টহল দল চলে এল তাঁদের আওতার মধ্যে। রঞ্জু সংকেত দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠল মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র।
আকস্মিক এই আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা একেবারে হতবিহ্বল। পাল্টা আক্রমণের তেমন সুযোগ পেল না তারা। মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে তাদের বেশ কয়েকজন হতাহত হলো। প্রাথমিক বিপর্যয় কাটিয়ে তারা কিছুক্ষণ পরই শুরু করল পাল্টা আক্রমণ। আশপাশে থাকা পাকিস্তানি সেনারাও যোগ দিল তাদের সঙ্গে। দুই পক্ষে যুদ্ধ চলল দুপুর পর্যন্ত। পাকিস্তানি সেনারা বিপুল ক্ষয়ক্ষতি শিকার করে শেষ পর্যন্ত রণে ভঙ্গ দিল। তারা পালিয়ে গেল গাইবান্ধার দিকে।
এ ঘটনা ১৯৭১ সালের ৩ নভেম্বরের। গাইবান্ধা জেলা সদর থেকে পূর্ব দিক বরাবর ১০-১১ কিলোমিটার দূরে বালাসীঘাট। পাকিস্তানি সেনারা এ ঘাটে নিয়মিত টহল দিত। ফলে এ পথ ব্যবহার করে গাইবান্ধায় অপারেশন চালানো মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছিল।
সেদিনের যুদ্ধে বেশ কজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। তবে তারা নিহত সেনাদের লাশ নিয়ে যেতে সক্ষম হয়। মুক্তিবাহিনী তাদের বেশ কিছু অস্ত্র ও বিপুলসংখ্যক গুলি হস্তগত করে। অন্যদিকে মুক্তিবাহিনীর ফজলু নামের একজন সদস্য শহীদ ও তাজুল ইসলাম টুকু নামের একজন গুরুতর আহত হন।
মাহাবুব এলাহী রঞ্জু ১৯৭১ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মার্চ-এপ্রিলের প্রতিরোধযুদ্ধে তিনি অংশ নেন। এরপর ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ শেষে ১১ নম্বর সেক্টরের মানকারচর সাব-সেক্টর এলাকায় যুদ্ধ করেন। এই সাব-সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা গাইবান্ধা এলাকায়ও যুদ্ধ করেন। তিনি ছিলেন গণবাহিনীর একটি কোম্পানির অধিনায়ক। তাঁর নামেই কোম্পানিটির নামকরণ হয়। রঞ্জু কোম্পানি গাইবান্ধা জেলার উড়িয়াঘাট, রতনপুর, দাড়িয়াপুর, ছাপড়াহাটি, বাদিয়াখালী, কাইয়ার হাট, কেতকীর হাটসহ কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারী এলাকার বিভিন্ন জায়গায় অ্যামবুুশ, সেতু ধ্বংস, প্রত্যক্ষ যুদ্ধসহ নানা ধরনের অপারেশনে অংশ নেয়।
সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, প্রথম খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১২
সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান