১৯৭১ সালের আগস্টের মাঝামাঝি একদিন। নিয়মিত ও গণযোদ্ধাদের সমন্বয়ে গড়া মুক্তিবাহিনীর একটি দল চিলমারীর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মূল অবস্থানে আক্রমণ করে। এম এ মান্নান ছিলেন একটি দলে। তিনি নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্য।
ব্রহ্মপুত্র নদের পশ্চিম তীরবর্তী চিলমারী কুড়িগ্রাম জেলার অন্তর্গত একটি উপজেলা। মুক্তিযুদ্ধের সময় সেখানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ৩২ বালুচ রেজিমেন্টের একটি কোম্পানি ও তাদের সহযোগী এক কোম্পানি ইপিসিএএফ, দুই কোম্পানি রাজাকার ও দুই প্লাটুন পুলিশ মোতায়েন ছিল। এদের মূল অবস্থান ছিল স্থানীয় রেলস্টেশন, হাইস্কুল ও ওয়াপদা অফিসে।
তখন মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের কাছে অস্ত্রশস্ত্র ছিল খুবই কম। সীমিত অস্ত্রশস্ত্র নিয়েই তাঁরা সেখানে আক্রমণ করেন। এ যুদ্ধের আগে ভারতীয় সেনাবাহিনী তাদের কয়েকটি মেশিনগান, লাইট মেশিনগানসহ অন্য আরও কিছু অস্ত্র ও গোলাবারুদ দিয়েছিল। কিন্তু সেদিন যুদ্ধক্ষেত্রে এসব অস্ত্রের বেশির ভাগই অকেজো হয়ে পড়ে। ফলে তাঁরা কিছুটা বিপদেই পড়ে যান।
রেলস্টেশনে পাকিস্তানি সেনাদের মেশিনগানের পজিশন বেশ সুবিধাজনক অবস্থায় ছিল। সেখান থেকে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর ব্যাপক গুলিবর্ষণ করছিল। তখন এম এ মান্নান ও তাঁর দুই-তিনজন সহযোদ্ধা সেই মেশিনগান ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নেন। স্টেশনের উত্তর দিকে একটি বাংকারে ছিল সেটি। তিনি ও তাঁর সহযোদ্ধা আবদুর রহিম (বীর বিক্রম) জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ক্রল করে সেদিকে যান। কিন্তু বাংকার লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছোড়ার সময় তিনি গুলিবিদ্ধ হন। মেশিনগানের পজিশনের কাছাকাছি আরেকটি বাংকারে থাকা পাকিস্তানি সেনারা তাঁদের দেখে গুলিবর্ষণ শুরু করে। সেদিন সেখানে দুই পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়।
এম এ মান্নান ১৯৭১ সালে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে যুদ্ধে যোগ দেন। ২৭ মার্চের পর তিনি পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে প্রথম যুদ্ধ করেন চট্টগ্রামের কুমিরা এলাকায়। তিনি তখন ছিলেন প্লাটুন কমান্ডার। এরপর তিনি তাঁর প্লাটুন নিয়ে যান হরিণায়, পরে ভারতের তেলঢালায়। এম এ মান্নান জেড ফোর্সের অধীনে ১১ নম্বর সেক্টরের রৌমারী এলাকার ঠাকুরের চর, নকশী বিওপি এবং বৃহত্তর সিলেট জেলার বড়লেখা, কমলগঞ্জসহ কয়েকটি জায়গায় যুদ্ধ করেন। কমলগঞ্জ যুদ্ধে তাঁর বুকে গুলি লেগে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে যায়।
১৯৮০ সালে এম এ মান্নানকে চাকরিচ্যুত করা হয়। তখন তাঁর পদমর্যাদা ছিল সুবেদার।
সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, প্রথম খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১২
সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান