বিজ্ঞাপন
default-image

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সৃষ্ট উত্তেজনা এবং নতুন যুক্তরাষ্ট্র-চীন মৈত্রীর পটভূমিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রে গ্রোমিকো ৮ আগস্ট দিল্লি সফরে আসেন।

বিকেলে দিল্লিতে পৌঁছে রাতেই আন্দ্রে গ্রোমিকো ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিংয়ের সঙ্গে ৬৫ মিনিট আলোচনা করেন। তাঁরা বাংলাদেশ-পাকিস্তান সংকটে উদ্ভূত যুদ্ধের হুমকি এবং ভারতীয় উপমহাদেশের শান্তি ও নিরাপত্তা প্রসঙ্গে পারস্পরিক স্বার্থ নিয়ে আলোচনা করেন। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে ১০ আগস্ট তাঁর বৈঠকের তারিখ নির্ধারণ করা হয়।

মস্কো থেকে যুক্তরাজ্যের দ্য অবজারভার পত্রিকার সংবাদদাতা দেব মুরারকা এদিন এক খবরে জানান, অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যে গ্রোমিকোর ভারত সফরের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উদ্বেগজনক হয়ে ওঠায় সোভিয়েত ইউনিয়ন অপ্রত্যাশিত এই সফরের ব্যবস্থা করে। তিনি বলেন, সম্প্রতি সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পাকিস্তানের সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। পূর্ব বাংলায় অনুসৃত দমননীতি প্রত্যাহার এবং বাংলাদেশের নেতা শেখ মুজিবের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রস্তাব উপেক্ষা করায় সোভিয়েত নেতারা পাকিস্তানের প্রতি রুষ্ট। হেনরি কিসিঞ্জারের গোপনে চীন সফরে পাকিস্তানি সহায়তায়ও মস্কো উদ্বিগ্ন।

দেব মুরারকা লেখেন, ওয়াশিংটনের উদ্যোগে রবার্ট জ্যাকসন নামে ভিয়েতনামফেরত এক অভ্যুত্থান-দমন বিশেষজ্ঞকে কিছুদিন আগে বাংলাদেশে পাঠানোর খবরও মস্কোর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। উপমহাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা সঞ্চয়, চীনের সম্ভাব্য ভূমিকা সম্পর্কে সতর্কবাণী উচ্চারণ এবং বাংলাদেশ সমস্যার ব্যাপারে মিসেস গান্ধীর প্রতি সোভিয়েত ইউনিয়নের সহানুভূতি ও সমর্থনজ্ঞাপনই গ্রোমিকোর সফরের মূল উদ্দেশ্য।

দিল্লিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানকে দেওয়া অব্যাহত সামরিক ও কূটনৈতিক সমর্থনে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের কাছে প্রতিবাদ জানিয়েছে। এসব কাজকে বৈরী মনোভাবাপন্ন উল্লেখ করে ভারত দিল্লির যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস এবং ওয়াশিংটনে প্রতিবাদ পাঠিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের কারণে ভারতের ওপর ক্রমশ বাড়তে থাকা যুদ্ধের চাপের প্রতি ভারত যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

default-image

সৈয়দ নজরুলের সতর্কবাণী

বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মুজিবনগরে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, বঙ্গবন্ধুর জীবননাশের প্রহসনমূলক বিচার থেকে বিরত না হলে এর দায় ইয়াহিয়াকে বহন করতে হবে। তিনি এই প্রহসনমূলক বিচার বন্ধের উদ্দেশ্যে ইয়াহিয়া খানের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য বিশ্বনেতাদের প্রতি আহ্বান জানান।

দ্য সানডে টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান পশ্চিম পাকিস্তানের জেলে সর্বোচ্চ শ্রেণিতে আছেন। তবে শেখ মুজিব যে বেঁচেই থাকবেন, সে নিশ্চয়তা তিনি দিতে পারেন না। দেশের আইনেই তাঁর বিচার হবে।

ঢাকায় গেরিলা অপারেশন

অবরুদ্ধ বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় এদিন রাত আটটার দিকে হলি ক্রস স্কুল পেরিয়ে ফার্মগেটের মুখে মুক্তিবাহিনীর ২ নম্বর সেক্টরের বদিউল আলম বদি, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, হাবিবুল আলম, পুলু, কামরুল হক স্বপন প্রমুখ গেরিলা একটি দুঃসাহসিক অপারেশন চালান। তাঁরা ফার্মগেটে একটি মোটরগাড়ি থেকে নেমে ক্ষিপ্রগতিতে সেখানে প্রহরারত পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের আক্রমণ করেন। এতে পাঁচজন পাকিস্তানি সেনা ও ছয় রাজাকার হতাহত হয়।

সুনামগঞ্জ জেলার জামালগঞ্জের সাচনায় পাকিস্তানি বাহিনীর একটি শক্তিশালী ঘাঁটি আক্রমণ করার জন্য একদল মুক্তিযোদ্ধা নিঃশব্দে এগিয়ে আসছিলেন। এ সময় পাকিস্তানি সেনারা বাংকার থেকে তাঁদের ওপর গুলি করতে শুরু করে। আকস্মিক হামলায় হকচকিত মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা আক্রমণ শুরু করেন। প্রবল গুলির কারণে মুক্তিযোদ্ধারা সামনে এগোতে পারছিলেন না। হতাহতের সংখ্যা বাড়ছিল। মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম সহযোদ্ধাদের ওই অবস্থানে থেকে গুলি চালাতে বলে একাই গ্রেনেড নিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে যান। গ্রেনেড চার্জ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দুটি বাংকার তিনি ধ্বংস করেন। তৃতীয় বাংকারে গ্রেনেড চার্জ করতে গেলে শত্রুর গুলিতে সিরাজুল ইসলাম শহীদ হন। তিনি ছাড়াও এ যুদ্ধে আরও পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও কয়েকজন আহত হন। পাকিস্তানি বাহিনীরও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। স্বাধীনতার পর শহীদ সিরাজুল ইসলাম বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত হন।

ফুটবল ম্যাচ

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে এদিন কলকাতার মোহনবাগান মাঠে বাংলাদেশ ফুটবল দল ও মোহনবাগানের খেলোয়াড় নিয়ে গড়া শ্রীগোষ্ঠ পালের একাদশের মধ্যে এক প্রদর্শনী খেলা অনুষ্ঠিত হয়। সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে বাদল অপরাহ্ণে এই খেলা দেখতে হাজার হাজার দর্শকের সমাগম হয়। মাঠের কর্মীরা এদিন কোনো পারিশ্রমিক নেননি।

বাংলাদেশের খেলোয়াড়েরা লাল গেঞ্জি, সবুজ প্যান্ট ও বুকে জয় বাংলা প্রতীক আর পিঠে বাংলা নম্বর লাগিয়ে খেলতে নেমেছিলেন। প্রথমে তাঁরা বাংলাদেশের পতাকা হাতে নিয়ে সারা মাঠ ঘুরে দর্শকদের শুভেচ্ছা জানান। দর্শকেরাও খেলোয়াড়দের অভিনন্দন জানান। এরপর দুই দলের মধ্যে ফুলের তোড়া বিনিময় হয়। খেলা চলার সময় দর্শকেরা বারবার ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেন। খেলায় বাংলাদেশ দল ৪-২ গোলে পরাজিত হয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি ও বাংলাদেশের স্বীকৃতির দাবিতে ভারতের রাজধানী দিল্লিতে এদিন কনস্টিটিউশন ক্লাব হলে এক নাগরিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন সাংসদ চন্দ্রদীপ যাদব। বক্তব্য দেন কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী আই কে গুজরাল ও মইনুল হক চৌধুরী এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতা মিজানুর রহমান চৌধুরী, অধ্যাপক হীরেন মুখার্জি প্রমুখ।

ব্রিটিশ শিক্ষার্থীর পদযাত্রা

বাংলাদেশের শরণার্থীদের সাহায্যে স্টিফেন উডরুক নামের ১৮ বছর বয়সী এক ব্রিটিশ ছাত্র স্কটল্যান্ডের উত্তরে জন গ্রোটস থেকে পদযাত্রা করে প্রায় ১ হাজার ৬১০ কিলোমিটার অতিক্রম করে ৮ আগস্ট ইংল্যান্ডের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তে পৌঁছান। এই দীর্ঘ পদযাত্রায় তাঁর ৩১ দিন সময় লাগে। পদযাত্রায় সংগৃহীত অর্থ স্টিফেন উডরুক বাংলাদেশের শরণার্থীদের সাহায্যার্থে দান করেন। এর উদ্যোক্তারা জানান, লন্ডনের ২১ বছর বয়সী আরেক শিক্ষার্থী মার্ক সারমান একই উদ্দেশ্যে জেরুজালেমের দিকে রওনা হয়েছেন।

সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, দুই ও পাঁচ; মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালি: যুক্তরাজ্য, আবদুল মতিন, সাহিত্য প্রকাশ; আনন্দবাজার পত্রিকাযুগান্তর, ভারত, ৯ ও ১০ আগস্ট ১৯৭১

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান