বিজ্ঞাপন
default-image

পাকিস্তান বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষক ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের উদ্দেশ্যে একাত্তরের ২০ আগস্ট করাচির মাশরুর বিমানঘাঁটিতে বেলা ১১টা ১৫ মিনিটে একটি টি-৩৩ প্রশিক্ষণ বিমান ছিনতাই করেন। বিমানটির নবীন পাইলট ছিলেন পাঞ্জাবি রাশেদ মিনহাজ। অনুশীলনের জন্য কন্ট্রোল টাওয়ারের ক্লিয়ারেন্স পেয়ে তিনি বিমানটি নিয়ে ২৭ নম্বর রানওয়েতে যেতে ৪ নম্বর ট্যাক্সি ট্র্যাক দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। মতিউর রহমান তখন ফ্লাইট সেফটি কর্মকর্তা। তিনি তাঁর ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে দ্রুত সেখানে গিয়ে রাশেদ মিনহাজকে থামার সংকেত দেন। রাশেদ মিনহাজ বিমানের ক্যানোপি তুলে মতিউর রহমানকে জিজ্ঞাসা করেন, কী হয়েছে? তখন মতিউর রহমান লাফ দিয়ে ককপিটে উঠে বিমানটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন। এরপর ভারতের উদ্দেশে রওনা দেন। একপর্যায়ে মিনহাজ বিমানের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করেন। তখন দুজনের মধ্যে ধস্তাধস্তি শুরু হলে সিন্ধুর বেদিনে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়ে মতিউর রহমান শহীদ হন।

ঘটনার বিভিন্ন ভাষ্য পাওয়া যায়। কেউ বলেন, মতিউর রহমান পাঞ্জাবি রাশেদ মিনহাজকে চেতনানাশক দিয়ে সংজ্ঞাহীন করে বিমানটি চালিয়ে ভারত সীমান্তের দিকে উড়ে যেতে থাকেন। কিছুক্ষণ পর রাশেদ মিনহাজ সংজ্ঞা ফিরে পেলে দুজনের মধ্যে ধস্তাধস্তি শুরু হয়। ফলে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়ে দুজনই মারা যান। আরেকটি ভাষ্যে বলা হয়, দুজনের মধ্যে শুরু থেকেই ধস্তাধস্তি চলে এবং বিমানটি আঁকাবাঁকা হয়ে আকাশের দিকে উঠে যেতে থাকে। কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে বিমানের পাখা দুটি অস্বাভাবিকভাবে কাঁপতে দেখে রাশেদ মিনহাজকে জিজ্ঞাসা করা হয়, কোনো সমস্যা হয়েছে কি না, কিন্তু কোনো উত্তর আসে না। বিমানটি খুব নিচ দিয়ে উড়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই সেটি কন্ট্রোল টাওয়ারের আড়ালে চলে যায়। কন্ট্রোল টাওয়ার তখন বেস কমান্ডারকে বিষয়টি জানায়। তারা আশঙ্কা করে, বিমানটি ছিনতাই হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যে দুটি এফ-৮৬ জঙ্গি বিমান সেই টি-৩৩ প্রশিক্ষণ বিমানের খোঁজে আকাশে উড়ে যায়। কিন্তু বিমানটির কোনো হদিস তারা পায়নি।

বিকেলের দিকে খবর আসে, ভারত সীমান্তের কাছে তালাহার নামের একটি জায়গায় বিমানটি বিধ্বস্ত হয়ে বিমানের দুজন আরোহীই মারা গেছেন। পাঞ্জাবি রাশেদ মিনহাজের দেহ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় এবং মতিউর রহমানের দেহ অবিকৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। ২০০৬ সালের ২৫ জুন তাঁর দেহাবশেষ বাংলাদেশে এনে পরদিন মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। স্বাধীনতার পর মতিউর রহমানকে বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবে ভূষিত করা হয়।

মতিউর রহমান একাত্তরের প্রথমার্ধ থেকে ছুটিতে বাংলাদেশেই ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি প্রতিরোধযুদ্ধেও অংশ নেন। পরে বয়োজ্যেষ্ঠদের চাপে সপরিবার পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যেতে বাধ্য হন। ৯ মে করাচি পৌঁছে মতিউর লক্ষ করেন বাঙালি কর্মকর্তাদের সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে। তাঁকেও প্রশিক্ষণের দায়িত্ব না দিয়ে দেওয়া হয় ফ্লাইট সেফটি কর্মকর্তার দায়িত্ব। এ অবস্থায় মতিউর একটি প্রশিক্ষণ বিমান নিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার চিন্তা করতে থাকেন। কিন্তু এর আগে পিআইএর একটি বিমান হাইজ্যাকের পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় বাঙালি পাইলটদের আকাশে উড্ডয়নের অনুমতি বাতিল করা হয়।

ভারত ও বহির্বিশ্ব

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সুইস নিউজ এজেন্সি ও সুইস বেতারে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ দিন বলেন, লাখ লাখ মানুষ পূর্ব বাংলা থেকে কেন চলে এল, তার মূল কারণ সম্পর্কে জাতিসংঘ নীরব। এই শরণার্থীদের দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার একটা পথ বের করতেই হবে। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা চাই শেখ মুজিব বেঁচে থাকুন। তাঁর সম্পর্কে আমাদের কাছে কোনো খবর নেই।’

সিপিআইয়ের জাতীয় পরিষদ দিল্লিতে সাত দিনব্যাপী বৈঠকের শেষ দিনে গৃহীত এক প্রস্তাবে দাবি জানায়, বাংলাদেশের সংগ্রামী জনগণ যাতে নিজেদের বাহিনীকে দিয়ে মাতৃভূমি মুক্ত করতে পারে তার জন্য ভারত সরকারকে সত্যিকারের কার্যকর ও ব্যাপক সাহায্য দিতে হবে। তবে এর জন্য সবচেয়ে বড় প্রয়োজন বাংলাদেশ সরকারকে ভারত ও অন্য দেশের স্বীকৃতিদান। পরিষদ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে অস্ত্র দেওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের তীব্র সমালোচনা করে।

ফিনল্যান্ডের হেলসিংকিতে এই দিন বিশ্ব শান্তি পরিষদের সচিবালয় এক বিবৃতিতে শেখ মুজিবুর রহমানের গোপন বিচারের তীব্র নিন্দা করে অবিলম্বে তাঁকে মুক্তি দিতে ইয়াহিয়াকে অনুরোধ জানায়।

পাকিস্তানে নানা তৎপরতা

পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ এদিন ঘোষণা করে, ১১ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে বিশেষ সামরিক আদালতে হাজির করা হয়। পাকিস্তানের আইন মন্ত্রণালয় আইনজীবী এ কে ব্রোহিকে মুজিবের পক্ষ নিতে অনুরোধ জানালে তিনি কাজের চাপ দেখিয়ে এই মামলা নিতে প্রথমে অক্ষমতা জানান, তবে পরে রাজি হন। শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করার জন্য এদিন সকালে করাচি ত্যাগ করেন। পাকিস্তান সরকারও এদিন ঘোষণা করে যে এ কে ব্রোহি শেখ মুজিবুর রহমানের কৌঁসুলি হিসেবে কাজ করবেন।

দ্য হেগের আন্তর্জাতিক আদালতের অন্যতম বিচারপতি জাফরুল্লাহ খান এদিন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দেখা করে শেখ মুজিবের বিচার নিয়ে কথা বলেন।

অবরুদ্ধ বাংলাদেশে পাকিস্তানি সামরিক গভর্নর ও সামরিক আইন প্রশাসক লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান এদিন স্বাধীন বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে আগামী ২৪ আগস্টের মধ্যে সামরিক আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন। দেশদ্রোহের অভিযোগ তুলে ফৌজদারি আইনে তাঁর বিচার হবে বলে জানানো হয়। বলা হয়, আদালতে হাজির না হলে তাঁর অবর্তমানেই বিচার হবে।

পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ এদিন আরও ১৩ জন এমএনএকে সামরিক আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়। এঁরা হলেন নূরজাহান মুরশিদ, মিজানুর রহমান চৌধুরী, এম ওয়ালিউল্লাহ, কাজী জহিরুল কাইয়ুম, খন্দকার মোশতাক আহমদ, খোরশেদ আলম, নূরুল ইসলাম চৌধুরী, মোহাম্মদ ইদ্রিস, মোস্তাফিজুর রহমান, খালেদ মোহাম্মদ আলী, খাজা আহমদ, নূরুল হক ও মোহাম্মদ হানিফ।

মুক্তিবাহিনীর গেরিলা অভিযান

মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধারা কুমিল্লা শহরের উত্তরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি টহল দলকে অ্যামবুশ করে। অ্যামবুশে কয়েকজন সেনা হতাহত হয়। গেরিলাদের আরেকটি দল রাতে নরসিংদীতে গ্যাসপাইপ লাইন উড়িয়ে দেয়। ৬ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা কুড়িগ্রামের চিলমারীর বিরাট এলাকা পাকিস্তানি সেনাদের হাত থেকে মুক্ত করেন।


সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর দুই, তিন ও ছয়; ‘বাংলার ইকারুস’, মশিউল আলম, প্রথম আলো, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৭; দৈনিক পাকিস্তান, ২১ ও ২২ আগস্ট ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকাযুগান্তর, ভারত, ২১ ও ২২ আগস্ট ১৯৭১

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান