দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র যুদ্ধ শেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি জাতি পায় কাঙ্ক্ষিত মুক্তিযুদ্ধে বহুপ্রত্যাশিত বিজয়। এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে পূর্ববঙ্গের আপামর জনতা পৃথিবীর মানচিত্রে জন্ম দেয় বাংলাদেশ নামে নতুন এক রাষ্ট্রের। হাজার হাজার মানুষের ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে ঢাকায় আবেগপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি হয়। পরাজিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি মুক্তি বাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সমন্বয়ে গড়া যৌথ বাহিনীর প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে অস্ত্র ও সেনা সমর্পণ করে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করেন। মুক্তি বাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করেন বাংলাদেশ বাহিনীর উপপ্রধান গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার। বাংলাদেশ বাহিনী ও মুক্তি বাহিনীর পক্ষে আরও ছিলেন এস ফোর্সের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল কে এম সফিউল্লাহ, ২ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক মেজর এ টি এম হায়দার, কাদের সিদ্দিকীসহ অনেকে।
এর আগে নিয়াজির নির্দেশে পাকিস্তানি বাহিনী ভোর পাঁচটা থেকে যুদ্ধবিরতি শুরু করে। সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ ভারতীয় বাহিনীর ডিভিশনাল অধিনায়ক মেজর জেনারেল গন্দর্ভ সিং নাগরাকে নিয়ে একটি সামরিক জিপ ঢাকার মিরপুর সেতুর কাছে এসে থামে। নিয়াজির জন্য নাগরার বার্তা নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় হেড কোয়ার্টারের দিকে সাদা পতাকা উড়িয়ে একটি জিপে রওনা দেন ভারতীয় ও বাংলাদেশ বাহিনীর দুজন সেনা কর্মকর্তা। বার্তাটিতে লেখা ছিল, ‘প্রিয় আবদুল্লাহ, আমি এখন মিরপুর ব্রিজে। আপনার প্রতিনিধি পাঠান।’
এর আগেই নিয়াজি যুদ্ধবিরতি ও অস্ত্র সংবরণের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতকে জানানোর জন্য ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের কনসাল অফিসে নিয়োজিত সামরিক অ্যাটাশেকে অনুরোধ করেন। দিল্লির যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের মাধ্যমে ভারত সরকারকে তা জানানো হয়। বেলা ১১টার দিকে যৌথ বাহিনীর দুই প্রতিনিধি নিয়াজির হেডকোয়ার্টার থেকে ফিরে আসেন। নিয়াজির প্রতিনিধি হিসেবে আত্মসমর্পণের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব নিয়ে আসেন মেজর জেনারেল জামশেদ। দুপুর ১২টার দিকে তাঁর সঙ্গে নাগরা নিয়াজির অফিসে পৌঁছান। এরপর শুরু হয় আত্মসমর্পণের শর্তাবলি নিয়ে কথাবার্তা। বেলা একটা নাগাদ কলকাতা থেকে ঢাকায় এসে পৌঁছান ভারতীয় বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব। ততক্ষণে যৌথ বাহিনী মিরপুর সেতু পেরিয়ে ঢাকায় ঢুকতে শুরু করেছে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের খবর বিদেশি বেতারে প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সান্ধ্য আইন উপেক্ষা করে অবরুদ্ধ ঢাকা নগরীর হাজার হাজার মানুষ মুক্তির উল্লাসে রাস্তায় নেমে আসে। ধানমন্ডিসহ পুরান ঢাকায় বেলা ১১টার দিকেই উল্লসিত জনতা রাস্তায় মিছিল বের করে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজধানীর সর্বত্র আত্মপ্রকাশ ঘটে মুক্তি বাহিনীর বীর যোদ্ধাদের।
বেলা একটার পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হেডকোয়ার্টারে বসে আত্মসমর্পণের দলিল তৈরির বৈঠক। এক পক্ষে নিয়াজি, রাও ফরমান আলী ও জামশেদ, অন্য পক্ষে জ্যাকব ও নাগরা। নিয়াজি আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর দিতে রাজি হন। সিদ্ধান্ত হয় আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করবেন বিজয়ী যৌথ বাহিনীর প্রধান জগজিৎ সিং অরোরা এবং পরাজিত বাহিনীর পক্ষে লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজি।
বিকেলে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) স্বাক্ষরিত হয় আত্মসমর্পণের ঐতিহাসিক দলিল, একাত্তরের ৭ মার্চ যেখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
বিকেল পৌনে চারটায় নিয়াজি রেসকোর্স ময়দানে আসেন। সামরিক বিধি অনুসারে বিজয়ী ও পরাজিত সেনারা শেষবারের মতো জেনারেল নিয়াজিকে গার্ড অব অনার জানায়।
বিকেল চারটা। নিয়াজি ও অরোরা এগিয়ে যান ময়দানে রাখা একটি টেবিলের দিকে। টেবিলের এক পাশে দুটি চেয়ার। অরোরা বসেন ডান দিকের চেয়ারে, বাঁয়ে নিয়াজি। অরোরা স্বাক্ষর করার জন্য দলিল এগিয়ে দেন নিয়াজিকে। নিয়াজির কাছে কলম ছিল না। ভারতীয় এক কর্মকর্তা তাঁর কলম এগিয়ে দিলে পরাজয়ের দলিলে স্বাক্ষর করেন নিয়াজি। পৃথিবীর ইতিহাসে এই প্রথম একটি নিয়মিত সেনাবাহিনী জনসাধারণের সামনে আত্মসমর্পণ করে। দলিলে স্বাক্ষর করে নিয়াজি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করে নেন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে। তখন বিকেল ৪টা ১ মিনিট।
দলিলে স্বাক্ষরের পর নিয়াজি উঠে দাঁড়িয়ে তাঁর পদমর্যাদার প্রতীক খুলে ফেলেন। কোমরে ঝোলানো রিভলবার বের করে একটি একটি করে সব বুলেট বের করে টেবিলের ওপর রাখেন। তারপর গুলিশূন্য রিভলবার এবং পদমর্যাদার প্রতীকগুলো তুলে দেন অরোরার হাতে।
ঢাকা থেকে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি) পাঠানো এক খবরে বলা হয়, আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করার সময় নিয়াজি অশ্রুসিক্ত ছিলেন।
মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ঘোষণা করেন, তাঁদের সরকার পরের সপ্তাহে ঢাকায় রাজধানী স্থানান্তর করবে। বাংলাদেশ সরকারের একজন মুখপাত্র জানান, ১৭ ডিসেম্বর থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে নতুন বেসামরিক প্রশাসন চালু করার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে।
‘ঢাকা স্বাধীন দেশের রাজধানী’
ভারতীয় সময় বিকেল সাড়ে পাঁচটা। ভারতের সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভার সব আসন পূর্ণ। সদস্য, সাংবাদিক ও দর্শক। দেশটির প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এসে বলেন, ‘আমি একটা ঘোষণা করতে চাই। আমার ধারণা, এই সভা কিছুকাল যাবৎ এই ঘোষণার প্রতীক্ষায় ছিল। [বাংলাদেশে] পশ্চিম পাকিস্তানি সেনারা বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করেছে। ঢাকা এখন একটি স্বাধীন দেশের স্বাধীন রাজধানী।’
ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের জনগণকে অভিনন্দন জানান এবং মুক্তি বাহিনীর বীরত্বে জয়ধ্বনি দেন।
সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ভারত, ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১; দ্য ইভিনিং স্ট্যান্ডার্ড, ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১; দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ, ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান