বিজ্ঞাপন
default-image

বাংলাদেশের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সৃষ্ট উত্তেজনার মধ্যে ৯ আগস্ট দিল্লিতে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় এ চুক্তি সে সময়ের ভূরাজনীতিতে একটি নিয়তি-নির্ধারক পদক্ষেপ হিসেবে আবির্ভূত হয়। সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রে গ্রোমিকো বলেন, এটি যুদ্ধের বিরুদ্ধে শান্তির চুক্তি।

চুক্তিটির মূল কথা ছিল তৃতীয় কোনো দেশ ভারতকে আক্রমণ করলে বা আক্রমণের হুমকি দিলে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারত শান্তি আর নিরাপত্তার স্বার্থে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আলোচনা করবে। আরও স্পষ্ট করে বললে, ভারত আক্রান্ত হলে বা যুদ্ধের হুমকি পেলে সোভিয়েত ইউনিয়ন তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে। সাহায্যের প্রকৃতি স্থির হবে পারস্পরিক আলোচনায়। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং সংসদে এই চুক্তি স্বাক্ষরের সংবাদ ঘোষণা করলে সবাই বিস্মিত হন। জনসংঘের ও স্বতন্ত্র সদস্যরা বাদে বাকি সবাই তুমুল হর্ষধ্বনি করে চুক্তিটিকে স্বাগত জানান।

default-image

এ চুক্তিতে জাতিসংঘে নিয়োজিত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকেরা বিস্মিত হন। যুক্তরাষ্ট্রেও বিস্ময়ের সৃষ্টি হয়। কূটনৈতিক মহলে এই আলোচনা চলে যে চুক্তিটি বাংলাদেশের ঘটনায় পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সৃষ্ট উত্তেজনা এবং ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ের মধ্যে চলমান কূটনৈতিক তৎপরতার জবাব।

বাংলাদেশ সরকার এ চুক্তিকে স্বাগত জানায়। তারা বলে, এ চুক্তির ফলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সোভিয়েত মনোভাবে পরিবর্তন ঘটবে। পাকিস্তানি প্রচারমাধ্যম চুক্তিটিকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতীয় আগ্রাসনের ছাড়পত্র বলে বর্ণনা করে। পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো একে পাকিস্তান ও চীনের বিরুদ্ধে আক্রমণ বলে আখ্যায়িত করেন।

বঙ্গবন্ধুর বিচারের খবরে প্রতিক্রিয়া

রাওয়ালপিন্ডিতে এক সরকারি বিবৃতিতে জানানো হয়, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করায় এবং অন্য অপরাধে একটি বিশেষ সামরিক আদালতে শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার হবে। বিচার শুরু হবে ১১ আগস্ট, চলবে গোপনে। অভিযুক্ত শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর বক্তব্য জানানোর জন্য উপযুক্ত সুযোগ এবং আইন অনুযায়ী সব রকম সুবিধাও পাবেন। পছন্দমতো আইনজীবী নিয়োগ করতে পারবেন। তবে আইনজীবীকে পাকিস্তানের নাগরিক হতে হবে।

বঙ্গবন্ধুর বিচারের খবরে যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। ওয়াশিংটনে তথ্য কর্মকর্তা জন কিং সাংবাদিকদের বলেন, বিচারের ব্যবস্থা নেওয়া হলে বাংলাদেশে যে প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে, সে জন্য তাঁরাও উদ্বিগ্ন।

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং শেখ মুজিবুর রহমানকে সামরিক আদালতে বিচারের হুমকি দেওয়ার গুরুতর পরিণাম সম্পর্কে পাকিস্তানকে হুঁশিয়ার করে দেন। লোকসভায় তিনি বলেন, এটি হবে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। সারা বিশ্বেরই এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো উচিত।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দিল্লিতে প্রায় ১০ লাখ লোকের সমাবেশে বলেন, তাঁর সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিরোধী নয়। তবে তাঁরা ভারত ও বাংলাদেশ—এই দুই দেশের জনগণের কল্যাণ নিয়ে সবচেয়ে বেশি ভাবিত। তিনি আশ্বাস দেন, এ অঞ্চলের জনগণের স্বার্থের সব দিক ভেবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডনে পাকিস্তান সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা বিভাগের উপপরিচালক এ কে এম আবদুর রউফ পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম কমিটির সভায় যোগ দিয়ে তিনি এ ঘোষণা দেন।

বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এ আর মল্লিক কলকাতার সাংবাদিকদের বলেন, বঙ্গবন্ধুর প্রাণ হননে উদ্যত পাকিস্তানকে রোখার জন্য বাংলাদেশ বুদ্ধিজীবী মুক্তিসংগ্রাম পরিষদ বিশ্ব জনতার সক্রিয় হস্তক্ষেপ দাবি করেছে।

গেরিলা অভিযান

চট্টগ্রাম বন্দরে অপারেশন জ্যাকপট পরিচালনার জন্য মুক্তিবাহিনীর ১ নম্বর সেক্টরের হরিণা ক্যাম্প থেকে প্রশিক্ষিত নৌকমান্ডো মুক্তিযোদ্ধারা ৯ আগস্ট তিন ভাগে বিভক্ত হন। প্রথম ও দ্বিতীয় দলটি স্থলপথে মিরসরাই ও চট্টগ্রাম শহর হয়ে কর্ণফুলীর পূর্ব পাড় চরলক্ষ্যার সর্বশেষ ঘাঁটিতে এবং তৃতীয় দল নৌকাযোগে চরলক্ষ্যায় রওনা দেয়। তিনটি দলেরই সার্বিক নেতৃত্বের দায়িত্ব দেওয়া হয় একজনকে।

মুক্তিবাহিনীর ২ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা পানিয়ারুপ এলাকায় পাকিস্তানি সেনাদের একটি দলকে আক্রমণ করে। এতে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।

কুড়িগ্রামে মুক্তিবাহিনীর ৬ নম্বর সেক্টরের গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল চিলমারী থানায় অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। এতে কয়েকজন পুলিশ হতাহত হয়।

বগুড়ার সাবগ্রামে বগুড়া-সারিয়াকান্দি সড়কে মুক্তিবাহিনীর ৭ নম্বর সেক্টরের গেরিলা যোদ্ধাদের পুঁতে রাখা মাইনের বিস্ফোরণে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত এবং একটি গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

যশোর জেলার ঝিকরগাছার পুলিয়ানি গ্রামে একজন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা একটি বাগান থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দলের ওপর গ্রেনেড নিক্ষেপ করেন। এতে একজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়।

পিরোজপুরে একদল গেরিলা যোদ্ধা কাউখালী থানা আক্রমণ করে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র হস্তগত করেন।


সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ১, ২, ৬, ৭, ৮ ও ৯; ইত্তেফাক, ১০ আগস্ট ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকাযুগান্তর, ভারত, ১০ ও ১১ আগস্ট ১৯৭১

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান