বিজ্ঞাপন
default-image

বেলজিয়ামের পক্ষ থেকে সেখানে সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে ২৫ অক্টোবর জানানো হয়, সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে কোনো সামরিক সরঞ্জাম পাকিস্তানকে সরবরাহ করা হয়নি। ন্যাটোর উদ্বৃত্ত অস্ত্রও পাকিস্তানে পাঠানো হয়নি। বাংলাদেশ ও ভারতের জনসাধারণের প্রতি বেলজিয়ামের সহানুভূতি রয়েছে। ব্রাসেলসে বেলজিয়ামের প্রধানমন্ত্রী গ্যাসটন ইসকেনসের সঙ্গে ইন্দিরার আলোচনায় বাংলাদেশ প্রসঙ্গই প্রাধান্য পায়।

বেলজিয়াম সরকার ভারতের বক্তব্যের সঙ্গে একমত হয় যে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সমাধানই
করতে হবে এবং শরণার্থীদের দেশে ফেরার নিরাপত্তা দিতে হবে। দুই প্রধানমন্ত্রীর আলাপের পর বাংলাদেশের ব্যাপারে বেলজিয়ামের মনোভাব আগের তুলনায় অনেক অনুকূল হয়।

ইন্দিরা গান্ধী এই দিন ব্রাসেলসে রয়্যাল ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস ভবনে বক্তৃতায় বলেন, পাকিস্তানের সামরিক শাসকেরা পূর্ববঙ্গের অধিবাসীদের বিরুদ্ধে গণহত্যামূলক অভিযান চালাচ্ছে। এটি নিছক গৃহযুদ্ধ নয়। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ভোট দেওয়ার কারণে নিরীহ জনগণকে নির্বিচার হত্যা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, পাকিস্তানের সমস্যার গভীরে আছে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য। রাজনৈতিক সমাধান ছাড়া এ সমস্যা মিটবে না। সমাধান ফলপ্রসূ হতে হলে সেটি বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের গ্রহণযোগ্য হতে হবে।

পক্ষত্যাগ বাঙালি কূটনীতিকের

মিসরের রাজধানী কায়রোয় পাকিস্তানি দূতাবাসের বাঙালি প্রধান ফজলুল করিম ২৫ অক্টোবর পদত্যাগ করেন। তিনি পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে যুক্তরাজ্যের উদ্দেশে রওনা দেন। লন্ডনে পৌঁছে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য জানাবেন।

পাকিস্তানি পক্ষত্যাগী বাঙালি কূটনীতিক হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী এই দিন দিল্লির বাংলাদেশ মিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন। দিল্লির বাংলাদেশ মিশনের কে এম শেহাবুদ্দিন ও আমজাদুল হক তাঁকে সহায়তা করবেন। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী দিল্লির পাকিস্তান হাইকমিশনে উপদেষ্টা ছিলেন। অক্টোবর মাসের প্রথমার্ধে তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রতি তাঁর আনুগত্য প্রকাশ করেন।

ফ্রান্সের বাংলাদেশ সহায়ক কমিটি এ দিন একটি ইশতেহার প্রকাশ করে। ইশতেহারে বিগত নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণের রায়কে মর্যাদা দেওয়ার দাবি জানানো হয়। ইশতেহারে চারটি প্রস্তাব রাখা হয়: ১. জনগণের জন্য আন্তর্জাতিক ত্রাণ সাহায্য পাঠানো, ২. রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করা, ৩. পাকিস্তানকে অস্ত্র দেওয়া বন্ধ করা, এবং ৪. পাকিস্তানে অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ করা।

ভারত আক্রমণাত্মক হবে না

ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম দিল্লিতে ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজে বক্তৃতাকালে বলেন, ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এমন কোনো ব্যবস্থা নেবে না, যাকে আক্রমণাত্মক কাজ বলা যেতে পারে। তবে ভারতের বিরুদ্ধে যেকোনো আক্রমণ পূর্ণ শক্তি দিয়ে প্রতিহত করা হবে।

ভারত সফররত সোভিয়েত ইউনিয়নের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোলাই ফিরুবিন দিল্লিতে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিংয়ের সঙ্গে ভারত উপমহাদেশের উত্তেজনা নিয়ে আলোচনা করেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গেও তিনি এ নিয়ে আলোচনা করেন।

মুক্তিবাহিনীর অভিযান

২ নম্বর সেক্টরের একদল গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা নারায়ণগঞ্জ সদর পোস্ট অফিসের সামনে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দলের ওপর বোমা নিক্ষেপ করেন। গেরিলাদের ছোড়া বোমা বিস্ফোরণে রাজাকারসহ বেশ কয়েকজন হতাহত হয়। হতাহতদের মধ্যে সাধারণ নাগরিকও ছিলেন।

এই সেক্টরের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা কাজলায় একটি কারখানায় অবস্থানরত রাজাকারদের লক্ষ্য করে বোমা ছোড়েন। বোমা বিস্ফোরণে কয়েকজন রাজাকার আহত হয়।

৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরে সাবদালপুর ও আনসারবাড়ী স্টেশনের মধ্যবর্তী স্থানে মাইন পুঁতে পাকিস্তানি বাহিনীর সেনা, মিলিশিয়া ও রাজাকারবাহী একটি ট্রেন অ্যামবুশ করেন। পাকিস্তানি বাহিনী প্রায়ই ওই রেলপথে চলাচল করত। মুক্তিযোদ্ধারা আগের দিন গুপ্তচর মারফত সংবাদ পেয়েছিলেন, ওই দিন ট্রেনযোগে পাকিস্তানিদের একটি বহর যাবে। খবর পেয়ে তাঁরা দুই স্টেশনের মধ্যবর্তী স্থানে মাইন পুঁতে রাখেন। ট্রেনটি মাইনের ওপর আসামাত্র বিস্ফোরণ ঘটে এবং তিনটি বগি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে পাকিস্তানি বাহিনীর বেশ কয়েকজন সেনা, মিলিশিয়া ও রাজাকার হতাহত হয়।

১১ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল জামালপুরের বকশীগঞ্জের অন্তর্গত কামালপুর সীমান্ত ফাঁড়ির কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দলকে আক্রমণ করে। এই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা বেশ কিছু অস্ত্র ও গোলাবারুদ হস্তগত করেন।

সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর দুই, আট ও এগারো; আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ভারত, ২৬, ২৭ ও ২৮ অক্টোবর ১৯৭১

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান